Thursday, August 14, 2014

তালাক দেওয়ার পর স্ত্রীকে ফিরে পেতে কথিত হিলা বা হালালা'র চুক্তি করা নাযায়েজ

তালাক দেওয়ার পর স্ত্রীকে ফিরে পেতে কথিত হিলা বা হালালা'র চুক্তি করা নাযায়েজ

তালাককে যারা পানি-ভাত মনে করেন তারা যে কোন সময় করুণ বিপদে পড়তে পারেন। একটা পশু জবাই করে কেউ যদি বলে ভুল হয়ে গেছে, হাজার চেষ্টা করেও যেমন ওই পশুর কর্তিত গলা জোড়া লাগানো যাবেনা - তেমনি একবার তালাক দিয়ে দিলে- তা রাগের মাথায় হোক, বা হাসতে হাসতে হোক বা যেভাবেই হোকনা কেন ওই স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে শরীয়ত অনুসারে। এটাই ইসলামী শরীয়তের ফায়সালা। অর্থাত তালাক প্রদানের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেলে স্ত্রীর দ্বিতীয় বার স্বাভাবিক নিয়মে বিয়ে হওয়া ব্যতীত তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী তার পূর্বের স্বামীর কাছে ফিরতে পারবেনা। এখন তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে যদি তালাক দিয়ে দেয় এবং যদি কোনো স্বাক্ষী না থাকায় পরে অস্বীকার করে, সেক্ষেত্রে তাদের বিবাহটা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন না হলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। তারা যদি তা গুরুত্ব না দিয়ে লুকিয়ে রেখে পুনরায় সংসার করতে থাকে সেক্ষেত্রে তারা জিনা ও কবীরা গুনাহে গুণাহগার হবে এবং কেয়ামতের দিন জনাখুরদের সাথে দাঁড়াবে।

পবিত্র কুরআনুল কারিমে তালাক সম্পর্কে বলা হয়েছে যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যাওয়ার আগে কিছু নিয়ম মানতে হবে যেমন (وَ اِنۡ خِفۡتُمۡ شِقَاقَ بَیۡنِہِمَا فَابۡعَثُوۡا حَکَمًا مِّنۡ اَہۡلِہٖ وَ حَکَمًا مِّنۡ اَہۡلِہَا ۚ اِنۡ یُّرِیۡدَاۤ اِصۡلَاحًا یُّوَفِّقِ اللّٰہُ بَیۡنَہُمَا ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ عَلِیۡمًا خَبِیۡرًا) আর যদি তাদের (স্বামী-স্ত্রী এ) দুজনের মাঝে বিচ্ছেদের আশঙ্কা দেখা দেয়, তাহলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে একজন এবং তার (স্ত্রীর) পরিবারের পক্ষ থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করো, এরা উভয়ে যদি নিষ্পত্তি চায়, তাহলে মহান আল্লাহ পাক তাদের (মীমাংসায় পৌছার) তাওফীক দেবেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক (সর্ব বিষয়ে) সম্যক জ্ঞানী, সর্ব বিষয়ে ওয়াকিবহাল (১)। (সূরা নিসা শরীফ ৪/৩৫)।

(১) উল্লেখিত ব্যবস্থাটি ছিল এ কারণে, যাতে ঘরের ব্যাপার ঘরেই মীমাংসা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু অনেক সময় মনোমালিন্য বা বিবাদ দীর্ঘায়িতও হয়ে যায়। তা স্ত্রীর স্বভাবের তিক্ততা ও অবাধ্যতা কিংবা পুরুষের পক্ষ থেকে অহেতুক কড়াকড়ি প্রভৃতি যে কোন কারণেই হোক এমতাবস্থায় ঘরের বিষয় আর ঘরে সীমিত থাকে না; বাইরে নিয়ে যাওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে। মহান আল্লাহ পাক এ ধরনের বিবাদ-বিসংবাদের দরজা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে সমসাময়িক শাসকবর্গ, উভয় পক্ষের সমর্থক ও পক্ষাবলম্বীদের এবং মুসলিম দলকে সম্বোধন করে এমন এক পবিত্র পন্থা বাতলে দিয়েছেন, তা হল এই যে, শাসক, উভয় পক্ষের মুরুত্ববী-অভিভাবক অথবা মুসলিমদের কোন শক্তিশালী দল তাদের (অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর) মধ্যে আপোষ করিয়ে দেয়ার জন্য দুজন সালিস নির্ধারণ করে দেবেন। একজন স্বামীর পরিবার থেকে এবং একজন স্ত্রীর পরিবার থেকে। এতদুভয় ক্ষেত্রে সালিস অর্থে (حكم) (হাকাম) শব্দ প্রয়োগ করে আল কুরআন নির্বাচিত সালিসদ্বয়ের প্রয়োজনীয় গুণ-বৈশিষ্টের বিষয়টিও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তা হচ্ছে এই যে, এতদুভয়ের মধ্যেই বিবাদ মীমাংসা করার গুণ থাকতে হবে। বলাবাহুল্য, এ গুণটি কেবল সে ব্যক্তির মধ্যেই থাকতে পারে, যিনি বিজ্ঞও হবেন এবং তৎসঙ্গে বিশ্বস্ত ও দ্বীনদারও হবেন।

বিয়ের সময় যেরূপ ২ জন শাক্ষি কবুলের সময় সম্মুখে থাকা বাধ্যতামূলক তালাকের সময় সেরূপ থাকা বাধ্যতামূলক নয়। কেউ না থাকলেও যদি কেউ তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেয়, তাহলেও তালাক পতিত হয়ে যাবে, বিয়ে বাতিল হয়ে যাবে, এদের জন্যে আর সংসার করা হালাল হবেনা। কেউ ফোনে বা ম্যসেজেও বললে অনুরূপ হুকুম। বউ না শোনলেও তালাক পতিত হয়ে যাবে, কেউ শোনা এইখানে জরুরী নয়, আল্লাহ পাক শোনাই যথেষ্ট। যেহেতু একটা শব্দকে সম্পর্ক ভাঙ্গার ওয়ে হিসেবে আল্লাহ পাক নিদৃষ্ট করেছেন, সেহেতু এর ব্যপারে সতর্ক থাকা ও লেহাজ করা উচিৎ।

এতএব বুঝা যাচ্ছে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যাওয়ার আগে অনেক প্রসেসিং করার পূর্ণ নির্দেশ মহান আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন দিয়েছেন তা না মেনে যদি তালাক দেওয়া হয় তাহলে পরিনতি কিন্তু মারাত্বক। প্রথমত তালাক তো হবেই, সাথে মহান আল্লাহ পাক উনার তরীকা অনুসারে এই নিকৃষ্ট হালা কাজ সম্পাদনের গুনাহ হবে, আল্লাহ পাক বলে দিলেন গরু কাটতে হলে ধিরে ধিরে নিয়ম মেনে তিন বার ছুরি চালিয়ে কাটবে, কিন্তু কেউ যদি সে নিয়মের পরোয়া না করে এক কোপে কেটে ফেলে তখন কেটে ফেলা তো হবেই, সাথে খোঁদার উপর খোদাগিরিও হবে। অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক উনার নাফরমানীও হবে।

স্ত্রীকে তিন তালাক দেওয়ার পর লজ্জিত হয়ে ভুল বুঝতে পেরে তাকে ফিরে পেতে হিলা বা হালালা পন্থা অবলম্বন করা বৈধ নয়। অর্থাৎ, স্ত্রীকে হালাল করার জন্য পরিকল্পিতভাবে কোন বন্ধু বা চাচাত-মামাতো ভাইয়ের সাথে বিবাহ দিয়ে এক রাত্রি সহবাস করিয়ে তালাক দিলে পরে ইদ্দতের পর নিজে বিবাহ করা এক প্রকার ধোঁকা এবং ব্যবিচার যাতে দ্বিতীয় স্বামী এক রাত্রি ব্যবিচার করে এবং প্রথম স্বামী ঐ স্ত্রীকে হালাল মনে করে ফিরে নিয়েও তার সাথে চিরদিন ব্যবিচার করতে থাকে। কারণ, প্রকৃতপক্ষে স্ত্রী ঐভাবে তার জন্য হালাল হয় না।

যে ব্যক্তি হালাল করার জন্য ঐরূপ বিবাহ করে, হাদীছ শরীফের ভাষায় সে হল ধার করা ষাঁড়। (ইরওয়াউল গালীল ৬/৩০৯) এই ব্যক্তি এবং যার জন্য হালাল করা হয়, সে ব্যক্তি (অর্থাৎ প্রথম স্বামী) মহান আল্লাহ পাক ও উনার রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের দ্বারা লানতপ্রাপ্ত। (মিশকাত ৩২৯৬)

তালাকের নিয়তে বিবাহ এক প্রকার ধোঁকাবাজি, বিয়ের মূল উসুলেরই খিলাফ এই হারাম কাজ বিদেশে গিয়ে বা দেশেই বিবাহ বন্ধনের সময় মনে মনে এই নিয়ত রাখা যে, কিছুদিন সুখ লুটে তালাক দিয়ে দেশে ফিরব বা চম্পট দেব, তবে এমন বিবাহও বৈধ নয়। (এরূপ করলে ব্যভিচার করা হয়।) কারণ, এতেও ঐ স্ত্রী ও তার সন্তানের অসহায় অবস্থা নেমে আসে।  (ফাতাওয়াল মারাআহ পৃষ্টা ৪৯) তাতে নারীর মান ও অধিকার খর্ব হয়।

কালামুল্লাহ শরীফে মহান আল্লাহ পাক বলেনঃ (فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُۥ مِنۢ بَعْدُ حَتّٰى تَنكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُۥ ۗ فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَآ أَن يَتَرَاجَعَآ إِن ظَنَّآ أَن يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ ۗ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ يُبَيِّنُهَا لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ) অতঃপর যদি সে (স্বামী) তার স্ত্রীকে (তৃতীয়) তালাক দিয়েই দেয় তাহলে তারপর (এ) স্ত্রী (আর) তার জন্য হালাল থাকবেনা, (১)  (হ্যাঁ) যদি তাকে অন্য কোন পুরুষ (স্বাবাভিক নিয়মে) বিবাহ করে (শারীরিক সম্পর্ক করে) এবং (নিয়ম মাফিক তাকে) তালাক দেয় এবং (পরে আবারো) তারা যদি মনে করে (যে) তারা (এখন স্বামী স্ত্রীর অধিকার সম্পর্কে) মহান আল্লাহ পাক উনার দেওয়া সিমারেখা মেনে চলতে পারবে, তাহলে তাদের পূনরায় (বিবাহ বন্ধনে) আবদ্ধ হতে কোন প্রকারের গুনাহ নাই। (২)। এটা হচ্ছে মহান আল্লাহ পাক উনার বেধে দেওয়া  সীমারেখা, যারা (এ সম্পর্কে) জানে মহান আল্লাহ পাক তিনি তাদের জন্য এই নির্দেশ সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করেন। (সূরাহ বাক্বারা শরীফ, ২/২৩০)

(২) অর্থাৎ কোন ব্যক্তি যখন তৃতীয় তালাক দিয়ে দেয়, তখন বৈবাহিক বন্ধন সম্পূর্ণভাবে ছিন্ন হয়ে গেল। তা আর প্রত্যাহার করার কোন অধিকার তার থাকবে না। কেননা, এমতাবস্থায় এটা ধরে নেয়া যেতে পারে যে, সবদিক বুঝে শুনেই সে স্ত্রীকে তৃতীয় তালাক দিয়েছে। তাই এর শাস্তি হবে এই যে, এখন যদি উভয়ে একমত হয়েও পুনর্বিবাহ করতে চায়, তবে তাও তারা করতে পারে না। তাদের পুনর্বিবাহের জন্য শর্ত হচ্ছে যে, স্ত্রী ইদ্দতের পর অন্য কাউকে বিয়ে করবে এবং সে স্বামীর সাথে সহবাসের পর সাধারণভাবে জীবনযাপন করা অবস্থায় কোন কারণে যদি এই দ্বিতীয় স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দেয়, অথবা মৃত্যু বরণ করে, তবে ইদ্দত শেষ হওয়ার পর প্রথম স্বামীর সাথে পুনরায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে।

কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফের এরশাদ সমূহ এবং সাহাবী রদ্বিল্লাহু তায়ালা আনহুম ও তাবেয়ী রহিমাহুল্লাহগণের কার্যপদ্ধতিতে প্রমাণিত হয় যে, যখন তালাক দেয়া ব্যতীত অন্য কোন উপায় থাকে না, তখন তালাক দেয়ার উত্তম পন্থা হচ্ছে এই যে, এমন এক তহুরে এক তালাক দেবে, যাতে সহবাস করা হয়নি। এক তালাক দিয়েই ছেড়ে দেবে। ইদ্দত শেষ হলে পরে বিবাহের সম্পর্ক এমনিতেই ছিন্ন হয়ে যাবে। ফকীহগণ একে আহ্‌সান বা উত্তম তালাক পদ্ধতি বলেছেন। সাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণও একেই তালাকের সর্বোত্তম পন্থা বলে অভিহিত করেছেন। (ইবনে আবী শায়বাঃ ১৭/৭৪৩)

ইবনে আবি-শাইবা রাহিমাহুল্লাহ উনার গ্রন্থে ইবরাহীম নাখা‌য়ী রাহিমাহুল্লাহ থেকে আরও উদ্ধৃত করেছেন যে, সাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ তালাকের ব্যাপারে এ পদ্ধতিকেই পছন্দ করেছেন যে, মাত্র এক তালাক দিয়েই ছেড়ে দিবে এবং এতেই ইদ্দত শেষ হলে বিবাহ বন্ধন স্বাভাবিকভাবেই ছিন্ন হয়ে যাবে, যদি ইদ্দতের ভেতর ফিরিয়ে না আনা হয়। মোটকথাঃ ইসলামী শরীয়ত তালাকের তিনটি পর্যায়কে তিন তালাকের আকারে স্থির করেছেন। এর অর্থ আদৌ এই নয় যে, তালাকের ব্যাপারে এ তিনটি পর্যায়ই পূর্ণ করতে হবে। বরং শরীয়তের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, প্রথমতঃ তালাকের দিকে অগ্রসর হওয়াই অপছন্দনীয় কাজ। কিন্তু অপারগতাবশতঃ যদি এদিকে অগ্রসর হতেই হয়, তবে এর নিম্নতম পর্যায় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকাই বাঞ্ছনীয়। অর্থাৎ এক তালাক দিয়ে ইদ্দত শেষ করার সুযোগ দেয়াই উত্তম, যাতে ইদ্দত শেষ হলে পরে বিবাহ বন্ধন আপনা-আপনিই ছিন্ন হয়ে যায়। একেই তালাকের উত্তম পদ্ধতি বলা হয়। এতে আরও সুবিধা হচ্ছে এই যে, এক তালাক দিলে পক্ষদ্বয় ইদ্দতের মধ্যে ভাল-মন্দ বিবেচনা করার সুযোগ পায়। যদি তারা ভাল মনে করে, তবে তালাক প্রত্যাহার করলেই চলবে। আর ইদ্দত শেষ হয়ে গেলে যদিও বিবাহ ভঙ্গ হয়ে যায় এবং স্ত্রী বিবাহমুক্ত হয়ে যায়, তবুও সুযোগ থাকে যে, উভয়েই যদি ভাল মনে করে, তবে বিয়ের নবায়নই যথেষ্ট। কিন্তু কেউ যদি তালাকের উত্তম পন্থার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে এবং ইদ্দতের মধ্যেই আরও এক তালাক দিয়ে বসে, তবে সে বিবাহ ছিন্ন করার দ্বিতীয় পর্যায়ে এগিয়ে গেল, যদিও এর প্রয়োজন ছিল না। আর এ পদক্ষেপ শরীয়তও পছন্দ করে না। তবে এ দুটি স্তর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও বিষয়টি পূর্বের মতই রয়ে যায়। অর্থাৎ ইদ্দতের মধ্যে তালাক প্রত্যাহারের সুযোগ থাকে। আর ইদ্দত শেষ হলে উভয়পক্ষের ঐকমত্যে বিয়ের নবায়ন হতে পারে। পার্থক্য শুধু এই যে, দুই তালাক দেয়াতে স্বামী তার অধিকারের একাংশ হাতছাড়া করে ফেলে এবং এমন সীমারেখায় পদার্পণ করে যে, যদি আর এক তালাক দেয়, তবে চিরতরে নবায়নের এ পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

(২) এখানে একটি বিষয় খুব গুরুত্বের সাথে দেখা উচিত। তা হচ্ছে, যদি কোন ব্যক্তি নিজের তালাক দেয়া স্ত্রীকে নিছক নিজের জন্য হালাল করার উদ্দেশ্যে চক্রান্তমূলকভাবে কারো সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় এবং প্রথম থেকে তার সাথে এই চুক্তি করে নেয় যে, বিয়ে করার পর সে তাকে তালাক দিয়ে দেবে, তাহলে এটা হবে একটি সম্পূর্ণ অবৈধ কাজ। এ ধরণের বিয়ে মোটেই হালাল বিয়ে বলে গণ্য হবে না। বরং এটি হবে নিছক একটি ব্যভিচার। আর এ ধরণের বিয়ে ও তালাকের মাধ্যমে কোন ক্রমেই তার সাবেক স্বামীর জন্য হালাল হয়ে যাবে না। প্রমূখ সাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এক যোগে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি এভাবে তালাক দেয়া স্ত্রীদের যারা হালাল করে এবং যাদের মাধ্যমে হালাল করে তাদের উভয়ের উপর লা'নত বর্ষণ করেছেন। (মুসনাদে আহমাদ শরীফ ১/৪৪৮, আবু দাউদ শরীফ ২০৬২, তিরমিযী শরীফ ১১১৯, ১১২০) বিয়ে করা সুন্নত, রহমতের কাজ, তো বিয়ে করে লানতপ্রাপ্ত হলে সেটা আর বিয়ে হবে কিভাবে। এরূপ যায়েজ হয়ে পতিতালয়ে গিয়ে প্রত্যেক রাতে দুইজন শাক্ষি রেখে বিয়ে করে সারা রাত মৌজ করে সকালে তালাক দিয়ে চলে আসাও হালাল হয়ে যায়। আমাদের টাকালোভি মৌলানারা কি এইসব বুঝে? হাজার টাকা বাজারের জন্যে পেলেই হারাম কে হালাল বলে ফতোয়া দিলে চলবে?

তালাক প্রদানের নিয়মঃ সাধারণত একজন স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেয়ার ক্ষেত্রে তালাকের সংখ্যা ৩টি। অর্থ্যাত পর্যায়ক্রমে তিন তালাক প্রদানের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ হতে পারে। ব্যতিক্রমও আছে। নিম্নে কয়েকটি অবস্থা আলোচনা করা হলোঃ

১. সাধারণত: স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল, মতানৈক্য তথা বনিবনা না হওয়ার কারণেই তালাক প্রদানের বিষয়টি উঠে আসে। এক্ষেত্রে স্বামী যদি তার স্ত্রীর কোনো বিষয় অপছন্দ করে অথবা তাদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয় তাহলে চুড়ান্ত ব্যবস্থা হিসেবে (অর্থাত সব রকম প্রচেষ্টা শেষ করার পর)স্বামী স্ত্রীকে ১ তালাক দিয়ে সতর্ক করে দিতে পারে। ১ম তালাক দিয়ে যদি তারা পরস্পর থেকে তিন (ব্যাখ্যা সাপেক্ষ্য) মাস বিচ্ছিন্ন থাকে তবে ১ তালাক বাইন হওয়ার দরুণ বিয়েটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। অর্থাত বাকি ২ তালাক আর দেয়ার প্রয়োজন থাকবেনা।

২. ১ম তালাক প্রদানের পরও যদি স্ত্রীর কোনোরুপ উন্নতি না দেখে অথবা তাদের মধ্যে সমঝোতা না হয়, সেক্ষেত্রে ১ম তালাক দেয়ার এক মাস পর স্বামী ২য় তালাক প্রদান করতে পারে, দ্বিতীয়বার তাকে সাবধান করে দেয়ার জন্য। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, ১ম ও ২য় তালাক প্রদানের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে যে, সে এক তালাক দিয়েছে বা ২ তালাক দিয়েছে। এরপর যদি আরো এক মাস কেটে যায় অর্থাত সর্বমোট তিনমাস কোনোরুপ সমঝোতা ছাড়া অতিবাহিত হলে ২ তালাক বাইন হয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। অথবা তৃতীয় মাসে তৃতীয় তালাক প্রদানের মাধ্যমে বিবাহ চিরতরে বিচ্ছেদ হতে পারে। এটাই মূলত: উত্তম পন্থা। সুন্নতী তরীকা।

৩. কিন্তু যদি সে স্ত্রীকে ত্যাগ করার উদ্দেশ্যে শুধু ৩ তালাক শব্দ উচ্চারণ করে তবে তার স্ত্রী  তৎক্ষনাত  তালাক হয়ে যাবে (রাগের মাথায় দিলেও)। তাছাড়া স্বামী-স্ত্রী চাইলে সজ্ঞানে তালাক সম্পন্ন করতে পারে। এটাই মূলতঃ উত্তম পন্থা। অর্থাৎ সার্বিক বিবেচনা করেই তালাকের সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। তালাক মূলতঃ রাগের সাথে সংশ্লিষ্ট না, অর্থাৎ রাগের বশঃবর্তী হয়ে তালাক প্রদান করা মোটেও উচিত নয়। এক্ষেত্রে তালাক প্রদানকারীসহ সংশ্লিষ্ট সকল পরিবারকে এক করুণ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। কখনো কখনো তা পুরো সমাজের জন্য বিশৃঙ্খলার কারণ হয়। যার অনেক প্রমাণ আমরা ইতোমধ্যে লক্ষ্য করেছি।

এটা হচ্ছে তালাকের স্বাভাবিক নিয়ম, তবে এছাড়া আরো অনেক কারণেই স্বামী-স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটতে পারে।  যেমন,

১. মুসলমান ব্যক্তি যদি কোনো হারাম কে হালাল, হালাল কে হারাম বলে। অথবা হারাম কাজে বা বিষয়ে আনন্দ প্রকাশ করে সেক্ষেত্রে তা কুফরী হয়। কেননা, হালালকে হারাম, হারামকে হালাল বলা বা মনে করা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। আর কুফরী করার কারণে মুরতাদ হওয়ার দরুণ তৎক্ষনাত ওই মুসলিম ব্যক্তি বিবাহিত হলে তাদের স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ওই কুফরী বা হারাম বিষয় থেকে খালিছ তওবা করতঃ পুনরায় বিবাহ দোহরানোর মাধ্যমেই তাদেরকে সাংসারিক জীবন অতিবাহিত করতে হবে। অর্থাৎ হিলা করার প্রয়োজন নেই, তবে বিয়ে দোহরায়ে বা পুনরায় বিবাহ সম্পাদন করতে হবে।

বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার আরেকটি মারাত্মক কারণ আছে। তা হলো, মহান আল্লাহ পাক না করেন, যদি শশুরের সাথে পুত্র বধূর কোনোরুপ অবৈধ সর্ম্পক হয়ে যায় বা শাহওয়াতের নিয়তে শ্বশুর স্পর্শ করেন, সেক্ষেত্রে পুত্র এবং তার বধূর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে এবং এই বিচ্ছেদ চীরস্থায়ী বিচ্ছেদ বলে বিবেচিত হবে। এটাকে হুরমতে মুসাহেরা বলা হয়। অর্থাত, ওই স্ত্রীকে ওই ছেলে আর কিছূতেই গ্রহণ করতে পারবেনা। সুতরাং, এক্ষেত্রে সকলের পর্দার বিষয়টা গুরুত্ব দেয়া জরুরী বলে মনে করি।

পরিশেষে বলতে হয়, সবচেয়ে নিকৃষ্ট হালাল কাজ বা জায়িয কাজ হচ্ছে তালাক। এক্ষেত্রে সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, ইসলামী শরীয়তে তালাক প্রদানের সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলী, নির্দেশনা রয়েছে। যা মূলতঃ তালাককে একটি অত্যন্ত বিবেচ্য বিষয় হিসেবে প্রমাণিত করে। তাই নিজের খেয়ালখুশির বশবর্তী হয়ে তালাক প্রদানের অধিকারের অপব্যবহার করা কারো জন্যই উচিত নয়। বিবাহ যেমন একটি সামাজিক ঐক্যমত্যের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বিষয় তেমনি তালাক প্রদানটাও সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করেই বাস্তবায়ন করা উচিত।

এতএব রাগের বশবর্তী হয়ে বা ইচ্ছায় অনিচ্ছায় একসাথে ৩ তালাক দেন তাহলে তালাক হয়ে যাবে এবং সেই মহিলা আপনার জন্যে হারাম হয়ে যাবে, তাই যতই রাগ উঠে না কেনো নিজেকে কন্ট্রোল করাই স্রেও না হলে আজিবন পস্থাবেন যদি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন কে ভয় করেন।