Friday, August 26, 2022

খোলা তালাক সম্পর্কে বাস্তবতার নিরিখে দলিল ভিত্তিক আলোচনা

দাম্পত্য জীবনের জন্য একান্ত অপরিহার্য বিষয় হচ্ছে, পারস্পরিক মুহব্বত, শান্তি, স্বস্থি, প্রেম-ভালবাসা, গভীর প্রীতি, আন্তরিক দরদ, সহানুভূতি, সহযোগিতা, উত্তম আচার-আচরণ, একে অন্যকে বোঝা এবং প্রত্যেকে একে অপরের অধিকার আদায়ের জন্য অতন্দ্র প্রহরীর মত সদা সচেতন ও সদাজাগ্রত থাকা। এরূপ না হলে দাম্পত্য জীবন মরুভূমির উপর দিয়ে নৌকা চালানোর কিংবা সমুদ্রের উপর দিয়া রেলগাড়ী চালানার মতই অসম্ভব কাজ। তাই দাম্পত্য জীবনে ঐ অবস্থারই উপস্তিতি কাম্য এবং লক্ষ্যণীয় যা মূলত একসাথে চলার প্রেরনা যোগায়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও একথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, অনেক সময় মধুর বন্ধনে আবদ্ধ থাকা দাম্পত্য জীবনেও বিপর্যয় চলে আসে। আর যখন বিপর্যয় এসেই পড়ে, তখন আর একসঙ্গে জীবন যাপনের কথা চিন্তা না করে, পরস্পর হইতে মুক্তি ও নিষ্কৃতি লাভের উপায় কি আছে ধর্মীয় দিক থেকে, তারাই খোঁজ করে যারা নিজেদের মুমিন মুমিনা ভাবে।

আর সম্মানিত দ্বীন ইসলাম এ অবস্থায় যে ব্যবস্থা রেখেছেন তাহাকে বলা হয় তালাক। এই তালাকের আবার তিনটি দিক রয়েছে, আমরা এখানে দুইটি নিয়ে আলোচনা করবো যা আমাদের আলোচনার সাথে সম্পর্কিত। প্রথমেই জেনে নেওয়া প্রয়োজন যে ডাইরেক্ট তালাক এর অধিকার কেবল পুরুষেরই আছে। হাদিস শরীফে এসেছে, “তালাক দেওয়ার ক্ষমতা কেবলই তার যার রয়েছে সহবাস করার অধিকার” অর্থাৎ স্বামীর। (ইবনে মাজাহ শরীফঃ ২০৮১) তাই কখনও যদি স্বামী ইহার প্রয়োজন বোধ করে, তাহলে সে নিজ উদ্যোগে নিজেই তালাক দিয়ে দেয়। আবার এমন কারনের উৎপত্তি হওয়াটাও কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয় যে, স্বামী হয়ত তালাক দেওয়ার প্রয়োজনবোধই করে না, কিন্তু স্ত্রী এই স্বামীর ঘর করিতে আর পারছে না, এই স্বামীর ঘর করা তাহার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন স্ত্রী উদ্যোগী হইয়া স্বামীর নিকট হইতে তালাক গ্রহণ করিতে সচেষ্ট হোন। আর এই দ্বিতীয় প্রকারের তালাক গ্রহণই হলো ‘খোলা তালাক’। আরেকটি বিবাহ বিচ্ছেদ বিদ্যামান যাকে লিআন বলে, তবে এটা আমাদের আলোচনার বিষয় নয় যেহেতু সেটা ইসলামিক খিলাফত থাকলেই কেবল বাস্তবায়ন সম্ভব।

এবার আসুন দেখি খোলার ব্যপারে কুরআন সুন্নাহ-এর মধ্যে কি পাওয়া যায়?

পবিত্র কুরআনে স্বামী-স্ত্রীকে “পরস্পরের জন্য পোষাক” স্বরূপ বলা হয়েছে। (আল কুরআন ২/১৮৭) আর স্বামীর নিকট থেকে স্ত্রী যেকোন কিছুর বিনিময়ে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়াকেই শারঈ পরিভাষায় ‘খোলা’ বলা হয়। কারণ ‘খোলা’র পারিভাষিক অর্থ হচ্ছ খুলে ফেলা। এছাড়াও খোলা শব্দের অর্থ মুক্ত করা, বিচ্ছিন্ন করা। যেমন আল কুরআনের অন্য যায়গায় আল্লাহ তাআলা বলেন, “হে মূসা আলাইহিস সালাম, আপনি আপনার জুতাজোড়া খুলে নিন, কেননা আপনি এখন তুওয়া নামক পবিত্র উপত্যকায় উপস্থিত আছেন” (আল কুরআন ২০/১২)

মূলত স্ত্রী যদি সঙ্গত কোন কারণে স্বামীর সাথে বসবাস করতে না চায় তাহলে স্বামী তার নিকট থেকে অথবা তার প্রতিনিধির পক্ষ থেকে বিনিময় গ্রহণ করে স্ত্রীকে নিজের বিবাহ থেকে পৃথক করে দেয়াকে খোলা তালাক বলা হয়।

এখন কথা হলো, সঙ্গত কারণ কি কি হতে পারে? যেমন স্বামীর প্রতি কোন কারণে মুহব্বত উঠে গেছে, তাঁকে ভালো লাগেনা, তার হক্ব আদায় করতে মন সায় দেয়না, তার সাথে সহবাসে তৃপ্ত হয়না, সে সন্তান দানে অক্ষম, অথবা দ্বীনি কাজে স্বামীর বাঁধা থাকে, দ্বীন পালনে আগ্রহ কম, বা স্বামী হারাম কাজে লিপ্ত থাকে বার বার নিষেধের পরেও। এবং আরেকটি বড় বিষয় হচ্ছে আক্বিদাহ গত যদি কোন সমস্যা থাকে। কিন্তু স্ত্রী যদি পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে অন্য কোন পুরুষকে মুহব্বত করে, আর তার সাথে সংসারের বাহানায় খোলা চায় তাহলে আমার মতে আহাল বাধ্য নয় তাঁকে খোলা করার সুযোগ দিতে, না এতে সে গুনাহগার হবে।

স্বাভাবিকভাবে খোলার ক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের সম্মতি থাকতে হবে। কিন্তু সঙ্গত কারণ থাকার পরেও যদি স্বামী সম্মতি প্রদান না করে, তাহলে স্ত্রী বিচারকের শরণাপন্ন হয়ে তার মাধ্যমে খোলা করবে। স্বামী স্ত্রীকে বিদায়ের অনুমতি দেয়ার পর যদি স্ত্রী পুনরায় উক্ত স্বামীর সংসার করতে চায়, তাহলে এ খোলা তালাকের ক্ষেত্রে স্বামী উক্ত স্ত্রীকে গ্রহণ করতে চাইলে পুনরায় বিয়ের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হবে নতুন মোহর দিয়ে। আর যদি অন্যত্র বিবাহ করতে চায়, তাহলে “এক হায়েজ অতিক্রম করার পর অন্যত্র বিবাহ করতে পারবে” (আবু দাউদ তিরমিযি)।

খোলার বিষয়ে মহান আল্লাহ তা’আলা বিধান হচ্ছেঃ ‘‘অতঃপর যদি তোমরা উভয় পক্ষের শালিসগণ) আশঙ্কা কর যে উভয়পক্ষ মহান আল্লাহ তা’আলার আইনসমূহ ঠিক রাখতে পারবে না, তাহলে উভয়ের প্রতি কোন গুনাহ নেই যদি কোন কিছুর বিনিময়ে স্ত্রী নিজেকে মুক্ত করতে চায়’’ (আল কুরআন ২/২২৯) আর যদি স্বামী বিনা মালে পরিত্যাগ করে তাহলে তা আরও ভাল।

আজকাল অনেক পুরুষ মনে চাইলেই যখন তখন স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেয়, কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় কোন দ্বীনদার নারী পারিবারিক চাপে যাচাই বাছাই করার সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়ে বিয়ে করে বসলেও, যখন বুঝতে পারে যে আমি যার সাথে সংসার করছি তার আর আমার চিন্তা চেতনা, আক্বিদাহ বিশ্বাসের মধ্যে অনেক তফাৎ তখন সেই মহিলা খোলা তালাক চাইলে সেই বদ আক্বিদার আহাল তা প্রদান করতে চায়না বরং উল্টো হাজারো বাহানা পেশ করে সাথে নিজকে পাক্কা মুমিন ও মনে করে, নাউযুবিল্লাহ!!!

অথচ মহান আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ ( وَ لَا تَعۡضُلُوۡہُنَّ لِتَذۡہَبُوۡا بِبَعۡضِ مَاۤ اٰتَیۡتُمُوۡہُنَّ اِلَّاۤ اَنۡ یَّاۡتِیۡنَ بِفَاحِشَۃٍ مُّبَیِّنَۃٍ) তোমরা তাদেরকে যা দিয়েছ তা থেকে কিছু আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে (১) তাদেরকে আটক রেখো না; যদি না তারা প্রকাশ্য অশ্লীলতা (ব্যভিচার বা স্বামীর অবাধ্যাচরণ) করে (২)। (আল কুরআন ৪/১৯)

১) এই যুলুমটি ছিল, যদি কোন স্বামীর নিকট স্ত্রীকে কোন কারণে পছন্দ না হত এবং সে তার নিকট থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাইত, তাহলে (এই রকম পরিস্থিতিতে ইসলাম যেভাবে তালাক দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে সেভাবে) সে তাকে তালাক না দিয়ে তার উপর অযথা সংকীর্ণতা সৃষ্টি করত; যাতে সে (স্ত্রী) বাধ্য হয়ে স্বামী প্রদত্ত দেনমোহর এবং যা কিছু সে দিয়েছে তা স্বেচ্ছায় ফিরিয়ে দিয়ে তার থেকে নিষ্কৃতি লাভ করাকে প্রাধান্য দেয়। ইসলাম এই আচরণকেও অত্যাচার ও যুলুম বলে গণ্য করেছে। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা বলেন ‘স্ত্রীদের বাসস্থানকে সংকীর্ণ করতঃ তাদেরকে কষ্ট দিয়ে বাধ্য করো না যে, তারা যেন সমস্ত মোহর বা মোহরের কিয়দংশ ছেড়ে দেয় বা তাদের অবশ্য প্রাপ্য কোন হক পরিত্যাগ করে। কেননা, তাদেরকে শাসন গর্জন করে এই কাজে বাধ্য করা হচ্ছে। হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এর ভাবার্থ এই যে, স্ত্রী পছন্দ হচ্ছে না, তার সাথে মনোমালিন্য হচ্ছে, কাজেই তাকে ছেড়ে দিতে চায়। কিন্তু ছেড়ে দিলে মোহর ইত্যাদি সমস্ত হক পুরোপুরি দিতে হবে। এর থেকে বাঁচবার জন্যে স্ত্রীকে কষ্ট দিচ্ছে এবং তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে, যেন সে নিজেই বাধ্য হয়ে সমস্ত প্রাপ্য ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। আল্লাহ পাক মুসলমানদেরকে এসব জঘন্য প্রথা হতে বিরত রাখেন।

এখন ফিকিরের বিষয় হচ্ছে, স্ত্রীকে তালাক না দিয়ে খোলা করাতে বাধ্য করাকে যেখানে যুলুম বলা হচ্ছে যেখানে যারা স্ত্রীকে মানসিক অত্যাচার, শারীরিক অত্যাচার, দ্বীনি অত্যাচার করে তালাক ও দেয়না, খোলা করতেও রাজি না তাদের অবস্থা কতটুকু ভয়ানক হতে পারে তা বলার বাহীরে।

২) ‘প্রকাশ্য অশ্লীলতা’ বলতে এইখানে ব্যভিচার অথবা গালাগালি ও অবাধ্যতাকে বুঝানো হয়েছে। এই উভয় অবস্থায় স্বামীকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে যে, সে তার সাথে এমন আচরণ করবে যাতে সে তার দেওয়া মাল বা দেনমোহর ফিরিয়ে দিয়ে খুলআ’ করতে বাধ্য হয়। বলা বাহুল্য, স্ত্রী খোলা (ত্বালাক) নিলে স্বামীকে দেনমোহর ফিরিয়ে নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আয়াতে বর্ণিত দোষ যদি পাওয়া না যায়, তাহলে সেটা যুলুমই হবে।

হদিস শরীফে খোলার বিষয়ে একটি ঘটনা পাওয়া যায়, যা এরূপঃ ইবনু আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, সাবিত ইবনু কায়স ইবনু শাম্মাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর স্ত্রী নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেনঃ হে রসূলাল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম! আমি সাবিতের দ্বীন ও চরিত্রের ব্যাপারে কোন দোষ দিচ্ছি না। তবে আমি কুফরীর আশঙ্কা করছি। রসূলাল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ তুমি কি তার বাগানটি ফিরিয়ে দিতে প্রস্তুত আছ? সে বললঃ হাঁ। অতঃপর সে বাগানটি তাকে (স্বামীকে) ফিরিয়ে দিল। আর রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার স্বামীকে নির্দেশ দিলেন, সে মহিলাকে পৃথক করে দিল। (অন্য বর্ণনায় এসেছে) সাবিত ইবনু কায়স ইবনু শাম্মাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর স্ত্রী নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন যে, তিনি তাকে মেরেছেন ও অঙ্গহানি করেছেন। মহিলা বল্লেন, মহান আল্লাহ তা’আলার কসম! আমি উনার দ্বীন বা চরিত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করি না বরং তার বেঁটে অবয়ব ও কুৎসিত চেহারার অভিযোগ করি। ইয়া রসূলাল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম! যদি মহান আল্লাহ তা’আলার ভয় না থাকত তাহ’লে বাসর রাতে আমি উনার মুখে থুথু নিক্ষেপ করতাম’। তখন রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম, ছাবিত রদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে ডাকালেন এবং উনার মতামত জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম! আমি তাকে ‘মোহর’ স্বরূপ আমার সবচেয়ে মূল্যবান দু’টি খেজুর বাগান দিয়েছিলাম, যা তার অধিকারে আছে। যদি সেটা সে আমাকে ফেরত দেয়। রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম তখন মহিলাকে বললেন, তুমি কি বলতে চাও। মহিলাটি বলল হ্যাঁ ফেরৎ দেব। চাইলে আরো বেশী দেব। তখন রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম ছাবিত রদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, তুমি তোমার স্ত্রীকে পৃথক করে দাও। অতঃপর তাই করা হ’ল। (বুখারি শরীফ ৫২৭৩, ৫২৭৬, নাসাঈ শরীফ ৩৪৬৩, মিশকাত শরীফ ৩২৭৪, বুলুগুল মারাম ৮/১১৪, এছাড়াও)

ইবনু জরীর রহমতুল্লাহ বলেন যে, উপরোক্ত ঘটনা উপলক্ষে অত্র আয়াত (বাক্বারাহ শরীফের ২২৯ এর দ্বিতীয়াংশ) নাযিল হয়। আবদুল্লাহ ইবনু আববাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ইসলামের ইতিহাসে এটাই হ’ল ‘খোলা’-র প্রথম ঘটনা এবং এটাই হ’ল খোলা-র মূল দলীল। (তাফসীরে ইবনে কাছীর ১/২৮১ পৃষ্টা)।

উপরোক্ত হাদিস শরীফে সাবিত ইবনু কায়স ইবনু শাম্মাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর স্ত্রী যে বল্লেন “তবে আমি কুফরীর আশঙ্কা করছি” উনার সাথে একত্রে বসবাস করার ব্যপারে। এই বিষয়ে অনেকের মনে সন্দেহ জাগতে পারে যে সাবিত ইবনু কায়স ইবনু শাম্মাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু কি উনার স্ত্রীকে কুফুরি করাতে বাধ্য করবেন বলে তিনি মনে করেছেন? কিন্তু না ব্যপারটা এরূপ না, মুল বিষয় হলো, সেই মহিলা এই হাদিসের হুকুম সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল এবং মান্যকারি ছিলেন। ইবনু আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমাকে জাহান্নাম দেখানো হয়। (আমি দেখি), তার অধিবাসীদের বেশির ভাগই নারীজাতি; (কারণ) তারা কুফরী করে। (তখন উনাকে) জিজ্ঞেস করা হল, “তারা কি মহান আল্লাহ তা’আলার সাথে কুফরী করে?” তিনি বললেনঃ (না বরং) “তারা (তাদের) স্বামীর অবাধ্য হয় এবং অকৃতজ্ঞ হয়”। (এটাই তাদের কুফুরি) তুমি যদি দীর্ঘদিন তাদের কারো প্রতি ইহসান করতে থাকো, অতঃপর সে তোমার সামান্য অবহেলা দেখতে (পায়, তখন সে) বলেই ফেলে, ‘আমি কক্ষণো তোমার নিকট হতে ভালো ব্যবহার পাইনি”। (বুখারি শরীফ ২৯) অন্য বর্ণনায় এসেছেঃ একবার ছ্বলাতুল কুসুফে দাঁড়ালে নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামকে যাহান্নাম দেখানো হয়, তিনি বলেনঃ আজকের দিনের মত দৃশ্য আমি আর কখনো দেখিনি। জাহান্নামের মধ্যে আমি অধিক সংখ্যায়ে মহিলাদের দেখেছি। (উপস্থিত) মহিলাগণ বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম! তা কেন? রসুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাদের কুফরের কারণে। মহিলাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, তারা কি মহান আল্লাহ তা’আলার সাথে কুফর করে? রসুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বললেন, না বরং তারা তাদের স্বামীর সাথে কুফর করে এবং অনুগ্রহের প্রতি অকৃতজ্ঞ থাকে। তুমি যদি তাদের একজনের প্রতি সারা যুগ ধরে অনুগ্রহ কর, তারপর কখনো (সে তোমার) সামান্য ক্রটি দেখতে পায়, তখন সে বলে উঠে তোমার থেকে কখনো কোন ভাল ব্যবহার পাই নি। (মুসলিম শরীফ ৯০৭এ)

অতএব একজন মহিলার স্বামী যে নমুনার ই হোক, আহালের আন্ডারে থাকা অবস্থায় তার আনুগত্য ফরজ, যতক্ষন না সে কোন কুফুরি কাজের আদেশ প্রদান করে। তাঁকে ভালো লাগুক বা না লাগুক, সে গরীব হোক বা শারীরিকভাবে অক্ষম হোক কিংবা অসুস্থ, তার বৌ থাকা অবস্তায় তার হক্ব আদায় করতে বাধ্য থাকবে স্ত্রী। তাঁকে সন্তুষ্ট রাখতে হবে। তার হুকুম অমান্য করা যাবেনা। স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার মাল থেকে কাউকে দান সদাকা করা যাবেনা। (বুলুগুল মারাম ৭/১১২) সে বাসায় থাকলে তার অনুমতি ছাড়া নফল রোজা রাখা যাবেনা, এমনকি কোন মানুষকেই ঘরে ঢোকার সুযোগ দেওয়া যাবেনা যদি না তার অনুমতি থাকে। (রিয়াদুস স্বলেহীন ২৮২) যদি কেউ আশংকা করে সে আহালের আনুগত্য করতে অক্ষম, যদি সে মনে করে তার হক্ব আদায়ে অক্ষম, যদি সে মনে করে তাঁকে মুহব্বত, ভালোবাসা তার পক্ষে আর সম্ভব নয়, তাহলে সে তার নিকট থেকে খোলা তালাক চাইবে তার দেওয়া মোহরনার বিনিময়ে, এবং আহাল বাধ্য থাকবে তাঁকে মুক্ত করে দিতে তার বিবাহ বন্ধন থেকে মোহরানা ফেরত নিয়ে। একমাত্র পরকীয়ায় জড়ানো স্ত্রীর বেলায় স্বামী বাধ্য নয়, মুক্তি না দিলে অপরাধিও হবেনা।

‘খোলা’ মূলতঃ ‘ফিসখে নিকাহ’ বা বিবাহ মুক্তি। কুরআনে দু’টি তালাক দেওয়ার পরে তৃতীয় তালাক-এর পূর্বে মালের বিনিময়ে বিবাহ মুক্তি বা ‘খোলা’-এর কথা এসেছে। এতে বুঝা যায় যে, ‘খোলা’ তালাক নয়, বরং বিচ্ছেদ মাত্র। যদি খোলা তালাকই হ’ত, তবে শেষের তালাকটি চতুর্থ তালাক বলে গণ্য হ’ত। অথচ প্রায় সকল ফকিই একমত যে, শেষে যে তালাক-এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি তৃতীয় তালাক, চতুর্থ তালাক নয়। নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম ছাবিত বিন ক্বায়েস রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর স্ত্রীকে ‘খোলা’ তালাক নেওয়ার পর তাকে ‘খোলা’র ইদ্দত স্বরূপ এক ঋতু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। (নাসাঈ শরীফ ৩৪৯৭, তিরমিঝি শরীফ ১১৮৫, আবু দাউদ শরীফ ২২২৯, ২২৩০, ইবনে মাজাহ শরীফ ২০৫৮)

উক্ত হাদীছটিও প্রমাণ করে যে, ‘খোলা’ তালাক নয়। কারণ যদি তালাক হ’ত, তবে উক্ত মহিলাকে তিনি তিন ‘ঋতু’ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলতেন। এছাড়াও আবূ দাউদ, নাসাঈ, মুওয়াত্ত্বা বর্ণিত খোলাকারিণী মহিলা ছাবিত রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর স্ত্রী জামীলা বা হাবীবাহ্-র বর্ণনায় এসেছে وَخَلِّ سبِيْلَهَا অর্থাৎ ‘মহিলাকে ছেড়ে দাও’। অতএব এ বিষয়ে উক্ত মহিলার বক্তব্যই ইহা প্রমাণিত। তালাক ও খোলা এক জিনিস নয়।

‘খোলা’ যে তালাক নয়, তার প্রমাণ হ’লঃ তালাকের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ তা’আলা যে তিনটি বিধানের কথা বলেছেন সেগুলির সবক’টি ‘খোলা’তে পাওয়া যায় না। তিনটি নিম্নরূপ-

(১) ‘তালাকে রাজঈ’র পর স্বামী তার স্ত্রীকে ইদ্দতের মধ্যে বিনা বিবাহে ফিরিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু ‘খোলা’ হ’লে স্ত্রীর সম্মতি ব্যতীত তা পারবে না।

(২) ‘তালাক’ তিনটি পর্যন্ত সীমিত। সুতরাং তালাকের সংখ্যা পূর্ণ হয়ে গেলে স্ত্রীর অন্য স্বামীর সাথে বিবাহ এবং মিলন এর পর স্বাভাবিক তালাক বা স্বামীর মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত প্রথম স্বামী তাকে ফিরিয়ে নিতে পারবে না। কিন্তু ‘খোলা’য় স্ত্রী অপর কারো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয়েই প্রথম স্বামীর কাছে নতুন বিবাহের মাধ্যমে ফিরে যেতে পারবে।

(৩) ‘খোলা’র ইদ্দত হ’ল এক ঋতু। পক্ষান্তরে সহবাস কৃত স্ত্রীর তালাকের ইদ্দত তিন ঋতু’।

ঋতুকালে বা পবিত্রকালে, সহবাস কৃত বা সহবাসহীন, সকল অবস্থায় স্ত্রী ‘খোলা’ করতে পারে। ‘মহরানা’ ফিরিয়ে দিয়ে বা অন্য কোন মালের বিনিময়ে ‘খোলা’ করাই দলীল সম্মত। তবে মালের বিনিময় ছাড়াও ‘খোলা’ সংঘটিত হ’তে পারে। বিশেষ করে স্বামীর পক্ষ থেকে যদি স্ত্রীকে ক্ষতিগ্রস্ত করার কুমতলব থাকে, তবে সেখানে মালের বিনিময় ছাড়াই আদালত উভয়ের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। কারণ হাদীছে এসেছে,  (اَ ضَرَرَ وَلاَ ضِرَارَ) “কোন ক্ষতি করা চলবে না, ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াও যাবে না”। (ইবনে মাজাহ ২৩৪০)

চার খলীফাসহ ছাহাবী আলীমদের মতে খোলা তালাকের ইদ্দত হ’ল এক ঋতুকাল। এছাড়াও স্ত্রীর সম্মতি ব্যতীত ইদ্দত কালের মধ্যে তাকে ফিরিয়ে নেওয়া জায়েয নয়। (তাফসীরে ইবনে কাছীর ১/২৮৩-৮৪; কুরতুবী ৩/১৪৩-৪৫) ইদ্দতকালের মধ্যে উভয়ের সম্মতিতে পুনরায় বিবাহ হ’তে পারে। তবে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে বোনদের খুব কঠিনভাবে, রসূলে পাঁক ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যে মহিলা তার স্বামীর নিকট থেকে কোন ক্ষতির (শারীরিক, মানসিক, প্রানের, দ্বীন হারানোর) আশংকা ছাড়াই তালাক প্রার্থনা করবে, সে মহিলা জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না’। (মিশকাত শরীফ ৩২৯৭)

আশাকরি, খোলার ব্যপারে করা এই খোলামেলা সহজ আলোচনা সেইসব ইমানদার ভাই ও বোনদের কাজে লাগবে যারা দ্বীনের হুকুম আহকাম মেনেই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলি নেন। আর ভুলত্রুটি আল্লাহ পাঁক ক্ষমা করুন, মহান আল্লাহ পাঁক তিনিই সমস্থ জ্ঞানের অধিকারী, আমিতো কেবল উনার ইল্মের কপি পেষ্ট কারী কাতিব।


সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুনঃ

এডমিন

আমার লিখা এবং প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা সম্পূর্ণ বে আইনি।

0 ফেইসবুক: