প্রথমতো জানার বিষয় হলোঃ কোন ছুন্নী মুছলিমের পক্ষে কি মাজারপূজারী হওয়া আদতে সম্ভব সে নিজে চাইলেও?
ওহাবি / ছ্বলাফিদের “মাজারপূজারী” অপবাদের কুরআন, ছুন্নাহ ও মানতেকি জবাবঃ
প্রথমতঃ “মাজারপূজারী” বলা তাকফির, এবং এটি একটি নিকৃষ্ট হারাম কাজ। কাউকে মাজারপূজারী বলা মানে তাকে মুশরিক সাব্যস্ত করা, যা ইসলামে ভয়াবহ একটি গুনাহে কবিরা। একজন ছুন্নী মুছলিমকে শুধু الظن বা ধারণার ভিত্তিতে “মুশরিক” বলা নির্ঘাত জুলুম এবং তাকফিরের শর্ত ভঙ্গ করা হয়।
দ্বিতীয়তঃ “পূজা” ও “ইবাদত” এর অর্থ এবং এর শর্ত
“পূজা” অর্থঃ কাউকে ইলাহ (উপাস্য) মনে করে তার প্রতি নতি স্বীকার, উৎসর্গ, ও ঈমানভিত্তিক ইবাদত করা। অথচ ছুন্নীরা পূজা করে না, যিয়ারত এ যায়, ফায়েজ, তাওয়াজ্জুহ হাছিল করতে যায়, কোনো ছুন্নী ব্যক্তি অলী বা মাজারকে ইলাহ মনে করে না, বরং আল্লাহ তা‘য়ালার প্রিয় বান্দা মনে করে, এমন একজন ছুন্নী পাওয়া যাবেনা যে মাজারে থাকা অলীকে ইলাহ মনে করে।
তৃতীয়তঃ ছুন্নীরা মাজারে যা
করে তা দুইটি বিষয় ব্যতীত কিছু নয়
১.
তাওয়াছছুল
(توسل) – মহান আল্লাহ তা’য়ালার নিকট অলীর উছিলা নিয়ে দোআ করা।
২. ইস্তিগাছা (استغاثة) – বিপদে “মহান আল্লাহ
তায়ালা উনার ওয়ালি/ফেরশতাদের নিকট সাহায্য চাওয়া”, যেন তিনি মহান আল্লাহ
তায়ালার প্রদত্ব ক্ষমতাবলে সাহায্য করেন বা মহান আল্লাহ তায়ালা উনার নিকট আমাদের সাহায্যের জন্য সুপারিশ করেন।
চতুর্থতঃ পূজার জন্য প্রয়োজন ‘উপাস্যতা’র বিশ্বাস – যা কোনো ছুন্নীর নেই, কেননা হিন্দুরা পূজা করে কারণ তারা বিশ্বাস করেঃ
⇒ বিষ্ণু দেবতা
সৃষ্টি
রক্ষণ করে
⇒ লক্ষ্মী
রিযিক
দেয়
⇒ কালী শাস্তি দেয়
> তারা প্রত্যেককে আলাদা আলাদা ইলাহ (উপাস্য) মনে করে। ছুন্নীরা কখনো আওলিয়া কিরামদের এইভাবে ইলাহ মনে করে না; তারা কেবল তাদের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত কামনা করে। যতক্ষণ না কোন জিনিসকে একক ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে কেউ সাব্যস্থ করবে ততক্ষণ আর যাই করুক পূজা অসম্ভব।
পঞ্চমতঃ একজন ছুন্নীকে “আসো মাজারে” বলা হলে সে প্রশ্ন
করে – কার মাজার?
⇒ যদি বলা হয়ঃ “আউলিয়াদের মাজার” সে খুশি হয়,
সম্ভব হলে যায়।
⇒ কিন্তু যদি বলা হয়ঃ “অমুছলিম কোন সন্ন্যাসীর” – তাহলে সে প্রকাশ্যভাবে প্রত্যাখ্যান করে, ব্রেইন নষ্ট হয়ে গেছে কিনা এরূপ চিন্তা করবে। কারণ, তার আকীদাহ বিশুদ্ধ এবং সে জানে কে আল্লাহর বন্ধু (ولي) আর সন্যাসিরা নয়।
মাজারপূজারী" বলা একপ্রকার তাকফির – এটা হারাম। ছুন্নীরা অলীদের ইলাহ মনে করে না বরং অলী মনে করে। তারা যা করে তা শুধুই তাওয়াছছুল ও ইস্তিগাছা – যা সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেঈন উনারা করতেন। হিন্দুদের মতো পূজা কখনোই ছুন্নীরা করে না, বরং তাদের আকীদাহ ঈমানসম্মত।
এখন আমি উপরোক্ত ৫টি মূল পয়েন্ট-এর প্রতিটি অংশ বিস্তারিতভাবে মানতেক, কুরআন শরীফ, হাদিছ শরীফ দ্বারা ব্যখা দেবঃ
১ম অংশঃ “মাজারপূজারীঃ বলা হল এক ধরনের
তাকফির – যা হারাম ও ভয়াবহ গুনাহ।
মানতেক ভিত্তিক ব্যাখ্যাঃ
⇒ “পূজারী” শব্দটি সেই ব্যক্তির জন্য ব্যবহৃত হয় যে কোনো সত্ত্বাকে ইলাহ বা উপাস্য মনে করে তাকে ইবাদত বা পূজা করে। কোন মুছলিমকে যদি “মাজারপূজারী” বলা হয়, তবে সে “ইবাদতের একমাত্র হক্বদার শুধুমাত্র মহান আল্লাহ তা’য়ালা” তাওহীদের এই মৌলিক নীতি সে অস্বীকার করলো বলা হলো, যার অর্থ সে মুশরিক। অতএবঃ কাউকে মাজারপূজারী বলা মানে তাকফির করা, তাকে মুশরিক সাব্যস্ত করা।
কুরআন শরীফের দলিলঃ পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফে মহান মহান আল্লাহ তা‘য়ালা বলেনঃ (یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا ضَرَبۡتُمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ
فَتَبَیَّنُوۡا وَ لَا تَقُوۡلُوۡا لِمَنۡ اَلۡقٰۤی اِلَیۡكُمُ السَّلٰمَ لَسۡتَ
مُؤۡمِنًا) হে ঈমানদারগণ!
যখন তোমরা মহান আল্লাহ তা’আলা উনার রাস্তায় বের হও (অভিযানে/সফরে/দ্বীনের তাবলীগে),
তখন যাচাই করে নিও (কে বন্ধু আর কে শত্রু)। আর কেউ যদি তোমাদেরকে ছালাম দেয়
(নিজেকে মুছলিম হিসেবে প্রকাশ করতে), তাহলে তাকে বলো না যে, “তুমি মু’মিন নও। (সূরা আন-নিসা ৪:৯৪)
➡ একজন কোন ছুন্নী মুছলিমকে যারা “মুশরিক”, “পূজারী”, “বেদাতী” বলে শুধুমাত্র তার
মাযার যিয়ারতের কারণে, তারা আল কুরআনের এই আয়াত অমান্য করেছে।
হাদিছ শরীফের দলিলঃ একজন ছুন্নী মুছলিমকে শুধু الظن বা ধারণার ভিত্তিতে “মুশরিক” বলা নির্ঘাত জুলুম এবং তাকফিরের শর্ত ভঙ্গ করা হয়। হাদিছ শরীফে রছুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু য়ালাইহি ওয়া আলিহি ওয়া ছাল্লাম বলেনঃ (مَنْ قَالَ لِأَخِيهِ يَا كَافِرُ، فَقَدْ بَاءَ بِهَا أَحَدُهُمَا) “যে ব্যক্তি তার (মুসলিম) ভাইকে বলে ‘হে কাফের’, তাদের একজন সেই কুফরের দোষে দোষী হয়ে যায়।” (বুখারী শরীফ ৫৭৫৩) মানে যাকে অপবাদ দেওয়া হলো, হাক্বিকতে সে তা না হলে এই তাকফির নিজের উপর পতিত হবে।
➡ ওহাবীরা যখন ছুন্নীদেরকে “মাজারপূজারী” বলে, তারা আসলে নিজেরাই ভয়ংকর তাকফিরে নিপতিত হচ্ছে কুরআন হাদিছ অনুসারে।
২য় অংশঃ ছুন্নীরা কখনোই পূজা
করে না, পূজার সংজ্ঞা
অনুযায়ী তা সম্ভব নয়
মানতেক ভিত্তিক ব্যাখ্যাঃ
➡ পূজা (Worship) = উপাস্যকে উদ্দেশ্য করে তার কাছে প্রার্থনা, নতি স্বীকার,
তার নামেই তাকে উৎসর্গ করে কুরবানী করা, ইত্যাদি।
হিন্দুদের পূজায় যা থাকেঃ
➡ ধূপধুনা, প্রসাদ নিবেদন
➡ দেবতাকে ভক্তির জন্যে
সেজদা
করা
➡ তাকেঃ সৃষ্টি, রিযিক, বিপদ মোচনের একক ক্ষমতাধর, মালিক মনে করা।
এসব কোন কিছুই কোন ছুন্নী মুছলমান কোনো মাযারে গিয়ে করে না বরং এগুলোকে হারাম হিসেবেই মানে।
কুরআন শরীফ থেকে উদাহরণঃ (وَ مَنۡ
یَّدۡعُ مَعَ اللّٰهِ اِلٰـهًا اٰخَرَ ۙ لَا بُرۡهَانَ لَهٗ بِهٖ ۙ فَاِنَّمَا
حِسَابُهٗ عِنۡدَ رَبِّهٖ ؕ اِنَّهٗ لَا یُفۡلِحُ الۡكٰفِرُوۡنَ) আর যে কেউ মহান আল্লাহ তা’য়ালার সঙ্গে এমন কোনো
ইলাহকে ডাকে (ডাকার যোগ্য মনে করে), যার কোনো দলিল তার কাছে নেই, তার হিসাব তার প্রভুর
কাছেই হবে। নিশ্চয়ই কুফরীকারীরা সফল হবে না। (সূরা আল-মু’মিনুন ২৩:১১৭)
➡ ছুন্নী মুছলিমরা অলি আউলিয়াদের মুশরিকদের মতো উপাস্য মনে করে না, বরং মহান আল্লাহ তা’য়ালার বন্ধু হিসেবেই সম্মান করে, তাযীম করে, অতএব পূজার কন্সেপ্টই নেই।
মাজারে গেলেই যদি পূজা হয়, তাহলে কাউন্টার এট্যাক দিচ্ছিঃ দেখি জবাব দিক?
ইউটিউব/ফেইসবুক ভরা ছ্বলাফি মুল্লা নুমান আলী খান, জাকির নায়েক সহ অসংখ্য কথিত স্কলারের, যেখানে আমরা দেখি যে ইছালামিক তাহযিব তামাদ্দুন এর বিপরীতে হাততালি দিচ্ছে, এখন প্রশ্ন হলো এইযে হাততালি দিচ্ছে, এর ব্যপারে কে ওহাবি/ছ্বলাফিরা কখনো ফাতওয়া দিয়েছে? না দেয়নি? কেন? কুকুর কুকুরের গোশত খায়না একারণেই? অথচ মহান আল্লাহ পাক বলতেছেনঃ (وَ مَا كَانَ صَلَاتُهُمۡ عِنۡدَ الۡبَیۡتِ اِلَّا مُكَآءً وَّ تَصۡدِیَۃً ؕ فَذُوۡقُوا الۡعَذَابَ بِمَا كُنۡتُمۡ تَكۡفُرُوۡنَ) কাবা শরীফের চত্বরে তাদের ইবাদত হাত তালি আর শিশ দেয়া ছাড়া আর কিছুই না, (এসব অপরাধে লিপ্ত ব্যক্তিদেরকে বলা হবে) ‘‘আযাব ভোগ কর যেহেতু তোমরা কুফরীতে লিপ্ত ছিলে’’। (ছুরা আল-আনফাল ৮:৩৫)
এছাড়াও কাবা শরীফ ও মদিনা শরীফে ধুনা, লোবান, চন্দনের ধোঁয়া-ধূপ দেওয়া হয়, মাজারে আগরবাতি শিরক, বিদআত পাঁথরের কাবায় ইবাদত? মানে মুনাফেকির কোন লিমিট ও নাই। অথচ এইসব ছাড়া হিন্দুদের পূজাই হয়না, এখন কি ওহাবীদের এই আমল “তাশাব্বুহ বিল কুফফার” কাফেরদের অনুকরণ হিসেবে মেনে নিবে? ক্বাবার পূজারী বলা শুরু করবে?
৩য় অংশঃ ছুন্নীদের মাযার
যিয়ারত মানে “তাওয়াছছুল ও ইস্তিগাছা”
মানতেকঃ তারা মাযারে গিয়ে অলীর উসিলায় মহান আল্লাহ তায়ালা উনার কাছে চায়, অলিকে উপাস্য বানায় না। এটি সেই প্রক্রিয়া, যেখানে একজন নেক বান্দার সম্মানে মহান আল্লাহ তা’য়ালার দয়া কামনা করা হয়।
হাদিছ শরীফ থেকে দলিলঃ হাদিছ শরীফে উওয়াইস আল-কারনী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মাধ্যমে
উমর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে ইস্তিগাছা করার নির্দেশ দেন খোদ রছুলে পাক ছ্বল্লাল্লাহু ইয়ালাইহি ওয়া আলিহি
ওয়া ছাল্লাম। (ছ্বহীহ মুসলিম, হাদীছ ২৫৪২)
➡ জীবিত এবং মৃত আওলিয়াগণের উসিলা এবং দোআর মাধ্যমে মাগফিরাত কামনা করা সুন্নতের অংশ।
ফিকহ থেকেঃ ইমাম ইবনে হাজার আল-হাইছামী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ফতওয়া হিসেবে বহু কিতাবে উদ্ধৃত হয়েছে (يَجُوزُ
التَّوَسُّلُ وَالِاسْتِغَاثَةُ بِالْأَوْلِيَاءِ)
কিতাবঃ الفتاوى
الحديثية
লেখকঃ الإمام
ابن حجر الهيتمي الشافعي رحمه الله (মৃত্যু: ৯৭৪ হিজরী)
পৃষ্ঠাঃ ১১৮ (পুরাতন সংস্করণ)
সেখানে স্পষ্টভাবে তিনি বলেনঃ (يجوز التوسل والاستغاثة بالأولياء والصالحين من عباد الله، وجزم به النووي وقال: لا فرق بين الحي والميت) আওলিয়া-এ কেরাম ও মহান আল্লাহ তা’আলার নেক বান্দাদের মাধ্যমে তাওয়াছছ্বুল ও ইস্তিগ্বছাহ বৈধ। এই বিষয়ে ইমাম নববী রহমতুল্লাহ দৃঢ়তার সাথে মত দিয়েছেন এবং বলেন, জীবিত ও মৃত উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। (الفتاوى الحديثية، ص: ١١٨)
৪র্থ অংশঃ “পূজার জন্য উপাস্যতা বিশ্বাস” আবশ্যক, যা ছুন্নীদেরই নয়, মুছলিম দাবীদার কারোরই নেই
মানতেকঃ উপাস্য
মানে এমন কেউ যার প্রতি আক্বীদাহ সহকারে ইবাদত করা হয়। ছুন্নীরা অলিদের এমন কিছুই মনে করে না, বরং “আল্লাহ তা’য়ালার বন্ধু, মহান আল্লাহ
তায়ালা উনার দরবারের সম্মানিত ব্যক্তি, শাফা'আতপ্রাপ্ত বান্দা” মনে করে।
➡ অতএব, তারা যে কর্মকাণ্ড করে তা কখনোই “পূজা” নয়, বলা যুলুম, যার অর্থ নিজেকে যালিম বানানো, আর
যালেমকে মহান আল্লাহ পাক কখনো হেদায়েত দেন না বলেছেন আল কুরআনের পরতে পরতে।
৫ম অংশঃ একজন ছুন্নীর যাচাই ‘কার মাজার’ জানতে চায়, যার দ্বারা তার আকীদা
পরিশুদ্ধ প্রমাণিত হয়
বাস্তব পর্যবেক্ষণঃ যদি বলা হয়, “চলেন, বড়পীর/গরিবে নেওয়াজ/শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহিমদের মাজারে যাই” তাহলে
সে খুশি
মনে রাজি হয়, কিন্তু যদি বলা হয়, “চলেন, গৌতম বুদ্ধ বা নানক সাহেবের মাজারে যাই” তাহলে সে কঠোরভাবে বিরোধিতা করে।
➡ এটি প্রমাণ করে, সে অলিকে মুছলিম মনে করে, এবং অমুসলিম গুরুকে ইলাহ বা সম্মানিতও মনে করে না।
উপসংহারঃ
“মাজারপূজারী” অপবাদ দেওয়া মানে ছুন্নী মুসলিমদেরকে তাকফির করা।
ছুন্নীরা
মাযারে গিয়ে কেবল তাওয়াছছুল ও
ইস্তিগাছা করে – পূজা নয়।
কুরআন, হাদিছ ও ফিকহ তিনটিতেই এটির বৈধতা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত।
আরো পড়ুনঃ (মাজারে সেজদা দেওয়া কি শিরক? কুফর?)
এর
পরেও কেউ যদি হেদায়েত না হয়, নিজেকে তাকফির থেকে হেফাজত না করে, তাহলে সে ইহুদী
নাছারাদের মতো মরুক কার কি আসে যায়?
0 ফেইসবুক: