কেউ
যদি কুরআন, হাদিছ, ও মানতেক দিয়ে কাউকে তাকফির করে তাহলে তা কি মেনে নিতেই হবে?
প্রথমে
মূল নীতিমালা, তাকফির (كُفْر) এর হুকুমঃ তাকফির করা অর্থাৎ কাউকে ইসলামের বাইরে বলে ঘোষণা করা,
শরীয়তের দৃষ্টিতে এটি খুবই ভয়ংকর একটি বিষয়। এতে
একজন ব্যক্তির জান-মাল-ইজ্জত হালাল হয়ে যেতে পারে, যদি প্রমাণিত কাফির হয়। কিন্তু ভুল তাকফির করলে নিজেই কাফির হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
রছুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু য়ালাইহি ওয়া আলিহি ওয়া ছাল্লাম বলেনঃ (مَن كَفَّرَ مُسْلِمًا فَقَدْ بَاءَ بِهَا أَحَدُهُمَا) যে ব্যক্তি একজন মুসলিমকে কাফির বলে, তাদের দুজনের একজন অবশ্যই এই (কুফরীর) দোষে পতিত হয়। (ছ্বহিহ বুখারী, হাদীছ শরীফ ৫৭৫৩) অর্থাৎ: যদি একজন মুছলিম অপর মুছলিমকে তাকফির করে কাফের বলে, তাহলে হয় সে নিজে কাফির হয়ে গেছে, নয়তো সে মিথ্যাচার করেছে যেটিই হোক, তাদের একজন এই ভয়াবহ গুনাহর ভার বহন করবে।
ইমামদের নীতি কি ছিলো?
চার মাযহাবের ইমামগণ (আবু হানিফা, মালিক, শাফিঈ, আহমদ ইবনে হাম্বল রহমতুল্লাহি য়ালাইহিম) এবং বহু মুহাক্কিক আলিম, যেমনঃ
ইমাম
নববী রহমতুল্লাহি য়ালাইহি।
ইবন
হজর আসক্বালানী রহমতুল্লাহি য়ালাইহি।
ইমাম
গাযযালী রহমতুল্লাহি য়ালাইহি।
ইমাম
ইবনে আবিদ্দীন শামী রহমতুল্লাহি য়ালাইহি।
-
সকলেই তাকফিরে অতি সতর্কতা অবলম্বন করেছেন, অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা উনারা অনুসরনীয়, উনারা আম হয়ে গেলে তাকফির ও আম
হয়ে যাবে। তাই উনাদের থেকে তাকফির খুব একটা
পাওয়া যায়না।
তাদের মূলনীতি ছিলোঃ (إِذَا وَجَدْنَا لِمَقَالِ الْكُفْرِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ وَجْهًا لِلْكُفْرِ، وَوَجْهًا وَاحِدًا لِلْإِيمَانِ، حَمَلْنَاهُ عَلَى الْإِيمَانِ) “যদি কোনো বাক্যে ৯৯টি দিক থেকে কুফর বোঝায় এবং ১টি দিক থেকে ঈমানের ব্যাখ্যা করা যায়, তবুও আমরা সেটাকে ঈমানের দিকেই ফিরিয়ে দেবো অথবা যদি আমরা কোনো বক্তব্যে কুফরীর নিরানব্বইটি দিক এবং ঈমানের একটি মাত্র দিকও পাই, তবে আমরা তা ঈমানের দিকেই গ্রহণ করব।” (তাফসিরে রূহুল মা‘আনী, ৫/৬৩; ইমাম ইবনে আবিদ্দীন, রাদ্দুল মুখতার)
তাকফিরের
প্রশ্নের জবাবকে তিনভাগে বিভক্ত করা যায়ঃ
১.
কেউ কুরআন, হাদীছ, এবং মানতেক দিয়ে তাকফির করছে, এটা কি যথেষ্ট?
উত্তরঃ না, শুধু কুরআন, হাদীছ এবং মানতেক ব্যবহার করে যাকে কাফির বলা হবে, সেই ব্যক্তি বা তার বক্তব্যে তাকফিরের সরাসরি দলীল থাকলেও তাকফির করার আগে এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবেঃ
সে
কুফরি কথার মানে বোঝে কিনা?
সে
ভুল বোঝে নি তো?
সে
তাওবাহ করেছে কিনা?
পেছনের
কোনো প্রসঙ্গ আছে কিনা?
ভুল ইজতিহাদ করেছে কিনা?
অন্যথায়, তাকে শরিয়তের দৃষ্টিতে একজন বিদআতী/গাফেল/মুনাহি/মুবারিয হিসেবেও বলা যাবে কিন্তু কাফির নয়।
২.
ইমামগণ অনেক বিষয়ে সাহস করেননি কিন্তু আপনি করেছেন – এটা কি গ্রহণযোগ্য?
আপনার ইলম যদি ইজতিহাদী লেভেলে পৌঁছায়, এবং আপনি শরিয়তের সকল শর্ত পূরণ করে, তাকফিরের জন্য সমস্ত দরজা বন্ধ দেখে সিদ্ধান্ত দেন - তাহলে সেটি আলোচনার যোগ্য হতে পারে। কিন্তু যদি ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে অতীত মুজতাহিদগণ নীরব থাকেন, তাহলে আপনি তাকফির করলে বর্তমান অনেক আলেম উলামারা বলতে পারেনঃ (مَا سَكَتَ عَنْهُ الأَئِمَّةُ فَاسْكُتْ عَنْهُ) যে বিষয়ে ইমামরা নীরব থেকেছেন, তুমিও সেই বিষয়ে নীরব থাকো।
৩.
আপনার কথা কি কখনো গ্রহণযোগ্য হবে?
হ্যাঁ
হবে, যদি আপনিঃ ইজতিহাদের এবিলিটি রাখেন। শরীয়তের
তাকফিরের ১০+ শর্ত পূরণ করেন (যেমনঃ হুজ্জত ইক্বামা, ইলম, নিয়ত, তাওবাহর সুযোগ ইত্যাদি)।
আলেমদের সামনে নিজের দলীল হাজির করলে তারা তাকে মান্য করেন, অন্তত চুপ থাকেন।
কেনো এতো শর্ত?
কেননা কারো বিরুদ্ধে কুফরের ফতওয়া দেওয়া অত্যন্ত গুরুতর বিষয়। এ বিষয়ে ইমামগণ ও উছূলবিদগণ কঠোর শর্ত বর্ণনা করেছেন, যাতে কোনো মুছলমানকে অন্যায়ভাবে কাফির সাব্যস্ত করা না হয়। নিম্নে মিনিমাম শর্ত পেশ করা হলো, যেগুলো যথাযথভাবে পূরণ না হলে তাকফির করা জায়েয নয়ঃ
শরঈ
তাকফিরের মূল ১৫টি শর্তঃ
১. ইছলামের মৌলিক বিষয় অস্বীকার করা (عِنَادًا / اِسْتِحْلَالًا) অর্থাৎ জেদ করে, হঠকারিতার বশে, অহংকার ও বিদ্রোহমূলক বিরোধিতা করে, কোনো হারাম জিনিসকে হালাল মনে করে, ঈমানের দৃষ্টিতে তা বৈধ বলে মনে করেই করে। যদি কেউ ইসলামের সুস্পষ্ট ও মৌলিক বিষয়কে জেনে–বুঝে অস্বীকার করে, এবং তা নিজের জন্য হালাল মনে করে, তখনই কুফরের হুকুম তার উপর একটিভেট হয়। উদাহরণস্বরূপ একজন য়া’লীমের উপর খুব সহজেই যে কাজের ফলে তাকফির করা যাবে তা একজন দিনমজুরের বেলায় যাবেনা।
২.
কুফরি কথা/কাজ করার পর সে ব্যক্তিকে তার বিষয়ে অবগত/জিজ্ঞেস করা।
> তাকে তার কথার ব্যাখ্যা/তাফসীর জানতে হবে। যদি তার কাছে কোনো ব্যাখ্যা থাকে, তাহলে তাকফির করা যাবে না।
৩.
তাকফিরের আগে হুজ্জত (প্রমাণ, দলিল) কায়েম করা।
> যে কথা বা কাজকে কুফর বলা হচ্ছে, তা শরঈভাবে প্রমাণসহ প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
৪.
তাকফিরযোগ্য বিষয়টি কুরআন ও ছ্বহীহ হাদীস (ছ্বনদে মতনে) দ্বারা সাব্যস্ত হতে হবে।
কোনো ইজতিহাদী বা মতভেদযোগ্য বিষয়ে তাকফির হয় না।
৫. কথাটি স্পষ্ট কুফরি হতে হবে – ৯৯ কুফরি সম্ভাবনা থাকলেও ১ ঈমানী ব্যাখ্যা থাকলে তাকফির করা যাবে না।
৬.
কুফরি কথা বললেও যদি সে জাহালতের কারণে বলে, তবে তাকফির নয়।
> জানার সুযোগ না পাওয়া, বা ভুল বুঝে বললে তাকফির হয় না। (ছুরা আত-তাওবা ৯:৬)
৭.
তাকফিরের ব্যাপারে আহলে ছুন্নতের ইজমা থাকলে তবেই তাকফির।
> আহলুছ ছুন্নতের বিভিন্ন ইমাম ও মাযহাবের মধ্যে মতভেদ থাকলে তাকফির করা যাবে না।
৮.
নাস বা দলিল কাত’ঈ (অর্থে ও সনদে স্পষ্ট) হতে হবে।
> যে আয়াত বা হাদীছ দিয়ে তাকফির করা হচ্ছে, তার অর্থে ও সনদে কোনো শুবহা থাকতে পারবে না।
৯.
কুফর নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর প্রযোজ্য কিনা তা নির্ণয়ের জন্য বিশুদ্ধ ক্বাযী বা আলিমের
দরকার।
> সাধারণ লোক বা অশিক্ষিত লোক কাওকে কাফির বলতে পারে না।
১০.
তাকফিরের জন্য অবশ্যম্ভাবী ফল ও পরিণতি বিবেচনায় রাখতে হবে।
> কারো তাকফিরের পর তার বিবাহ ভেঙে যায়, জানাযা পড়া যায় না এগুলো খুবই গুরুতর বিধান। সুতরাং হালকাভাবে তাকফির করা যায় না।
১১.
তার কুফরি কথা বা কাজ দ্ব্যর্থহীন (واضح) হতে হবে।
> ব্যক্তি এমন কিছু বলেছে যার একাধিক অর্থ হতে পারে, তাহলে তাকে তাকফির করা যাবে না।
১২. কুফরি কাজ ইচ্ছাকৃত (عن عمد) হতে হবে, অনিচ্ছাকৃত বা ভুলে করলে তাকফির হয় না।
১৩. শরীয়ত যাকে মুসলিম বলেছে তাকেও মুসলিম মানতে হবে, জ্ঞান ছাড়া কেউ কাউকে কাফির বললে সে নিজেই কাফির হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে।
১৪.
ব্যক্তির অবস্থা বিবেচনায় না নিয়ে তাকফির করা যাবে না।
> যেমনঃ যুদ্ধের সময়, তাগুতী শাসনের ভয়ে, চাপের মুখে বলা, এসব ক্ষেত্রে কুফরি শব্দ বললেও তাকফির নয় (ছুরা নাহলঃ ১০৬)
১৫.
শরীয়ত কাউকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করলে তাকফির করা বিদআত।
> যেমন নামায পড়ে, রমজানে রোযা রাখে, কুরআন মানে তাকে কাফির বললে তাকফিরকারি বিদআতি হয়ে যায়।
যাদের মধ্যে এই শর্তগুলো পূরণ হয়নি, তাদের তাকফির করা মহা অপরাধ। আর যে নিজেই তাকফিরের যোগ্য নয়, সে অন্যকে তাকফির করলে নবীজী ছ্বল্লাল্লাহু য়ালাইহি ওয়া আলিহি ওয়া ছাল্লাম বলেছেনঃ (فَقَدْ بَاءَ بِهَا أَحَدُهُمَا) সে কথাটি দুজনের এক জনের উপর পড়বে।
শেষ
কথাঃ তাকফির করা ইলমের শীর্ষ পর্যায়ের কাজ, এটি একা করা অনুচিত। অতএব, যেখানে ইমামরা নীরব থেকেছেন, সেখানে নীরব থাকাই
ছুন্নাত। সাহস নয়, ইলম, দয়া, রাহমত এবং উম্মতের
ফায়দা হচ্ছে, এটাই প্রকৃত মনোভাব হওয়া উচিৎ।
0 ফেইসবুক: