ত্বরীকাহ শব্দ শুনলে আজকাল দেখি অনেক মানুষ নাক সিটকায়, বিশেষ করে বাতিল ফেরকার ব্রেইন ওয়াশ করা যুবক-যুবতিরা। আসলে আফসোস লাগে এদের হাল দেখে, মহান আল্লাহ পাক এদের চোখ, কান, ব্রেইন, ক্বলব সবই দিয়েছেন, কিন্তু এগুলো তারা দিয়ে দিয়েছে তাদের শুয়ুখরুপী শয়তানের ক্বলবের অধিকারীদের নিকট। তাদের ঐ কথিত শুয়ুখরা যা বলে তাই তারা সঠিক মনে করে যদিও তা কুরআন ছুন্নাহর ১৮০* বিপরীত হয়। তারা যদি মানুষ হতো, মুছলিম হতো, তাহলে অবশ্যই তাফাক্কুর, তাদ্বাব্বুর করতো। কুরআন-ছুন্নাহ আহলে জিকর থেকে জানতো, এবং মানতোও। কিন্তু শুয়ুখরুপী শয়তানের ক্বলবের অধিকারীদের নিকট থেকে হাক্বিকি দ্বীন জানা ও শিখা তো আর বাস্তবে সম্ভব না। তাই ত্বরীকত ব্যতীত শরীয়ত দিয়ে মহান আল্লাহ পাক উনাকে পাওয়ার চেষ্টা করা জাহেলিয়াত। আশ্চর্য লাগে যখন বিশাল বিশাল ডিগ্রিধারী জাহিল মুল্লারাও মানুষকে ত্বরীকত তথা ইলমে তাসাউফের পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে, মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে, ব্রেইন ওয়াশ করে কেবল শরিয়তপন্থী বানিয়ে দেয়। আর তাদের মূর্খ মুকাল্লিদরাও তা চোখ বন্ধ করে গিলতে থাকে। অথচ ত্বরীকত ব্যতীত শরীয়ত দ্বারা মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট যাওয়ার, পৌঁছানোর কোন সুযোগই নাই। ত্বরীকত শব্দ শুনলেই কথিত লা-মাজহাবি, অধিকাংশ দেওবন্দি, ছলাফি লাফ দিয়ে উঠে, ভাবখানা এমন যেনো এইটা অমুছলিমদের কোন কিতাব থেকে এসেছে, অথচ ত্বরীকাহ শব্দ খোদ কুরআন শরীফ থেকেই এসেছেন। আর ত্বরীকাহ এসেছেন ত্বরীক থেকে। আর ত্বরীক-এর মানে হলো রাস্তা, পথ, ডাইরেকশন।
সম্মানিত কুরআন ছুন্নায় বিশ্বাসী মুও’মিনগণ আসুন দেখি আমরা ত্বরীকাহ কি? ত্বরীকাহ নিয়ে নাক সিটকানোর কিছু কি আছে? নাকি নাক সিটকিয়ে বেঈমান মরদুদ শয়তান হতে হচ্ছে।
“ত্বরীকাহ” শব্দের অর্থঃ আরবি শব্দ “طَرِيقَةٌ” (ত্বরীকাহ) এসেছে “طَرَقَ” ধাতু থেকে, যার অর্থ “পথ”, “পথে হাঁটা”, “চলা”, “পদ্ধতি”, বা “ধারা” অথবা “কোনো কিছুকে ধাক্কা দিয়ে খোলা”। শব্দটি অর্থগত দিক দিয়ে বোঝায়ঃ- “নির্দিষ্ট পদ্ধতি, অভ্যাস, বা জীবনধারা”। কুরআন শরীফে এই শব্দটি একাধিকবার এসেছে, যেমনঃ ছুরা ত্ব-হা এর ২০/৬৩ নং আয়াত শরীফে, ২০/১০৪ নং আয়াত শরীফে, ছুরা জ্বীনের ৭২/১৬ নং আয়াতে। প্রত্যেক জায়গায় “ত্বরীকাহ” শব্দটি এমন এক পথ বা পদ্ধতির ব্যপারে ব্যবহৃত করা হয়েছে, যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে ‘আদর্শিক বা শ্রেষ্ঠ’ পথ হিসেবেই বিবেচিত ছিলো। যদিও উক্ত আয়াতসমূহে তা এসেছে কাফিরদের বক্তব্য ও প্রসঙ্গের ভেতরে, তথাপি আল্লাহ তা’য়ালা সেই শব্দ ব্যবহারে কোনো নাকচ করেননি, বরং তাদের নিজেদের ভাষায় তুলে ধরেছেন। এ থেকে বোঝা যায় “ত্বরীকাহ” শব্দটি কুরআন দ্বারা স্বীকৃত, এবং তা জীবনধারা, চিন্তাধারা, বা ধারাবাহিক রূহানী পন্থা বোঝাতে ব্যবহারযোগ্য।
মহান আল্লাহ পাক কালামুল্লাহ শরীফে বলেনঃ (وَّ اَنَّا مِنَّا الۡمُسۡلِمُوۡنَ وَ مِنَّا الۡقٰسِطُوۡنَ ؕ فَمَنۡ اَسۡلَمَ فَاُولٰٓئِكَ تَحَرَّوۡا رَشَدًا وَ اَمَّا الۡقٰسِطُوۡنَ فَكَانُوۡا لِجَهَنَّمَ حَطَبًا وَّ اَنۡ لَّوِ اسۡتَقَامُوۡا عَلَی الطَّرِیۡقَۃِ لَاَسۡقَیۡنٰهُمۡ مَّآءً غَدَقًا لِّنَفۡتِنَهُمۡ فِیۡهِ ؕ وَ مَنۡ یُّعۡرِضۡ عَنۡ ذِكۡرِ رَبِّهٖ یَسۡلُكۡهُ عَذَابًا صَعَدًا) (জ্বীনেরা বললো) আর আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মুসলিম, আবার কেউ কেউ অবিচারকারী; অতএব যারা আত্মসমর্পণ করেছে, তারাই হেদায়েতের তালাশ করেছে। কিন্তু যারা অবিচারকারী, তারা তো জাহান্নামের ইন্ধন (হয়েছে)। (পেয়ারে হাবীব ছ্বল্লাল্লাহু য়ালাইহি ওয়া আলিহি ওয়া ছাল্লাম আপনি বলুন) আর (আমার কাছে ওয়াহী করা হয়েছে এই মর্মে) যে যদি তারা ত্বরীকাহ-এর উপর অবিচল থাকতো, তাহলে আমি তাদেরকে অফুরন্ত বরকতময় পানি দ্বারা সমৃদ্ধ করতাম, যাতে আমি তাদেরকে এটা দিয়ে পরীক্ষা নিতে পারি। আর যদি কেউ তার রবের জিকির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তিনি তাকে কঠোর আযাবে প্রবেশ করাবেন। (ছুরাহ আল জ্বীন ৭২/১৪-১৭)
অতএব আমরা উক্ত ৪ আয়াত থেকে যা পেলাম তা হলো (رَشَدًا) রশাদ হচ্ছে মুওমিনদের এমন এক অবস্থা যেখানে তারা তাদের জীবন সঠিক/হেদায়েতের পথে পরিচালনা করেন। অর্থাৎ মুর্শিদের দেখানো পথে, কেননা মুর্শিদ শব্দের মূল ধাতুই হচ্ছেন রশাদ, আর যিনি রশাদ বা সঠিক পথের দিকনির্দেশনা দেন তিনিই মুর্শিদ। এরপর পেলাম (الطَّرِیۡقَۃِ) ত্বরীকাহ যার অর্থ “পথ”, “পথে হাঁটা”, “চলা”, “চলার পদ্ধতি”। এরপর পেলাম (ذِكۡرِ رَبِّهٖ) রবের জিকির।
অতএব, আমরা এই আয়াতগুলো থেকে বুঝি, রশাদ (হেদায়েত) হচ্ছেন মুমিনদের এমন এক অবস্থা যেখানে তারা সঠিক পথে চলেন, অর্থাৎ আল্লাহ ওয়ালা মুর্শিদের দেখানো পথে। আর ত্বরীকাহ হচ্ছেন নির্ভেজাল, সঠিক হক্ব পথ, জীবনযাপন পদ্ধতি যা মুর্শিদের ছ্বহবত থেকে রবের যিকির দ্বারা অর্জিত হয়।
আর আহলুছ ছুন্নাহ এর আক্বিদাহ-বিশ্বাসে ১০০% বিশ্বাসী “প্রত্যেক ত্বরীকাহ-ই হক্ব পথ, তবে যা শরিয়তের ভিত্তিতে পরিচালিত নয়, তা হলো বিভ্রান্তি।” অর্থাৎ, ত্বরীকাহ কখনোই শরীয়তের বাইরের কোন বিষয় নয়, বরং এটি শরীয়তের ভিতরেই আত্মশুদ্ধির গভীর পথ। শরীয়তকে শরীর বললে, ত্বরীকাহ তার রূহ। যেকোন ত্বরীকাহ যা আহলুছ ছুন্নাহ-এর আক্বীদাহ বিশ্বাসের বিপরীতে বিশ্বাস রাখে, আমল করে তা বাতিল।
ত্বরীকার প্রয়োজন কেন?
মূলত তালিমে ত্বরীকাহ হচ্ছেন ঐ তালীম বা শিক্ষা, যা অর্জন করে সম্মুখে থাকা হাজারো ভ্রান্ত রাস্তার মধ্যে সঠিক রাস্তা চিনে সেই পথ ধরে মাক্বসুদে মঞ্জিলে অনায়াসে পৌঁছে যাওয়া। অতএব শরীয়ত মূলত কানুন বা লো। আর ত্বরীকত হলেন রাস্তা যেখানে আইন এপ্লাই করা হয়।
একজন মুসলিম যে মহান আল্লাহ পাক উনাকে হাছিল করতে চায়, তাকে শরীয়তের মাধ্যমে নফছের তাঁহারাত হাসিল করতে হয়। আর যখন শরীয়তের পাবন্দ হয়ে নফছের তাঁহারাত হাসিল করে ফেলে, তখন ক্বলবি জিকির দ্বারা সে ত্বরীকতে প্রবেশ করে।
শরীয়তে তাছলিম হওয়ার মাধ্যমে নফছ পাক হয়ে যায়। আর যখনই নফছ পাক হয়ে যায়, তখনই সে মুর্শিদের অনুমতি সাপেক্ষে ক্বলবের জিকির শুরু করে দেবে, ফলশ্রুতিতে সে ত্বরীকতে দাখিল হয়ে যাবে, অর্থাৎ তখন তার যাত্রা শুরু হয়ে যাবে। আর ত্বরীকত মূলত ক্বলব বেদার বা জাগ্রত হওয়ার মাধ্যমেই শুরু হয়ে থাকে। আর সেটার ফাইনাল ডেসটিনেশন হয় বাকাবিল্লাহতে। মানুষ রূহের জগত থেকে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত যে যাত্রা করছে, এর পুরোটাই মূলত ত্বরীকতের উপর হয়ে থাকে। এমনকি যা মানুষকে জাতে ইলাহিতে পৌঁছে দেয় তাই ত্বরীকত।
শরীয়ত হচ্ছেন আইন অর্থাৎ একটি গাড়ি নিদৃষ্ট রাস্তায় চলার কানুন → আর ত্বরীকত হচ্ছেন সেই রাস্তা যার উপর ছ্বফর করে মুছাফির তার মঞ্জিলে পৌঁছায়। একজন ব্যক্তি যত ভালো ড্রাইভার হোক, আর যতই সে আইন-কানুন জানুক বা মানুক, যদি সে সঠিক রাস্তা না চিনে তাহলে তার পক্ষে গন্তব্যে পৌঁছানো অসম্ভব, অর্থাৎ শরীয়ত জেনেও সে গুমরাহ হয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াবে। একারণেই ফরজ ইবাদতের আগে মহান আল্লাহ তায়ালা তাজকিয়ার তাকীদ করেছেন, যা ত্বরীকার অনুসারী হওয়া ছাড়া কারো পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব নয়। যেমন মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ (قَدْ أَفْلَحَ مَن تَزَكَّىٰ وَذَكَرَ اسْمَ رَبِّهِ فَصَلَّىٰ) “কামিয়াব হলো সেই ব্যক্তি, যে তার নফছের তাজকিয়া করলো, আর তার রব তায়ালা উনার জিকির করলো এরপর গিয়ে নামাজ আদায় করল।” (ছুরা আল-য়া‘লা, ৮৭:১৪-১৫)
অতএব প্রথমে নফছের তাজকিয়া করে তারপর ইছমে জাত আল্লাহ/লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ দ্বারা হুজুরি ক্বলব বানিয়ে তারপর নামাজ পড়লে সেটা হাক্বিকি ইবাদত বলে গন্য হবে।
এখন কথা হচ্ছে, নতুন ত্বরীকাহ সৃষ্টির বৈধতা কি আছে?
এটা বুঝতে হলে মূল নীতি বুঝতে হবেঃ নতুন “দ্বীন” সৃষ্টি করা যাবে না, তবে নতুন ত্বরীকাহ (আত্মশুদ্ধির বৈধ, শরিয়তসম্মত পদ্ধতি) তৈরি করা যাবে যদি তা কুরআন-ছুন্নাহ ও আহলে ছুন্নাত ওয়াল জামাআতের মূলনীতি বিরোধী না হয়।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ (كُنۡتُمۡ خَیۡرَ اُمَّۃٍ اُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ
تَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ تَنۡهَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡكَرِ وَ تُؤۡمِنُوۡنَ
بِاللّٰهِ) তোমরাই সর্বোত্তম উম্মাত, মানবজাতির (সর্বাত্মক
কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভূত করা হয়েছে, তোমরা সৎকাজের আদেশ দাও এবং অসৎ কাজ
হতে নিষেধ কর এবং মহান আল্লাহ তায়ালা উনার প্রতি ঈমান রক্ষা করে চল। (ছুরা আলে ইমরান ৩/১১০)
→ প্রতিটি যুগে “উত্তম কাজের আদেশ” পৌঁছানোর পদ্ধতি আলাদা হতে পারে ভিন্ন ভিন্ন ত্বরীকায়।
এছাড়াও মহান আল্লাহ তায়ালা উনার মৌন সম্মতিও পাওয়া যায়
উনার নৈকট্য লাভের জন্যে যেকোন পথ, পদ্ধতি, ত্বরীকাহ উদ্ভাবনে, যেমন তিনি বলেনঃ (وَ جَعَلۡنَا فِیۡ قُلُوۡبِ الَّذِیۡنَ اتَّبَعُوۡهُ
رَاۡفَۃً وَّ رَحۡمَۃً ؕ وَ رَهۡبَانِیَّۃَۨ ابۡتَدَعُوۡهَا مَا كَتَبۡنٰهَا
عَلَیۡهِمۡ اِلَّا ابۡتِغَآءَ رِضۡوَانِ اللّٰهِ فَمَا رَعَوۡهَا حَقَّ
رِعَایَتِهَا ۚ) ঈসা য়ালাইহিছ ছালামের অনুসারীদের
অন্তরে দিয়েছিলাম করুণা ও দয়া; কিন্তু দরবেশী জীবনতো তারা নিজেরাই মহান আল্লাহ তা’য়ালার
সন্তুষ্টি লাভের জন্য উদ্ভাবন করেছিল; আমি তাদের উপর ফরজ করিনি; অথচ এটাও তারা
যথাযথভাবে পালন করেনি। (ছুরা হাদিদ ৫৭/২৭)
→ পূর্ববর্তী উম্মত, ঈসা য়ালাইহিছ ছালামের ছ্বহাবিরা নিজেরা নতুন ইবাদতের পন্থা তৈরি করেছিলেন মহান আল্লাহ তা’য়ালার নৈকট্য হাছিলের উদ্দেশ্যে (যদিও তা মহান আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর ফরয করেননি), তবে আফসোস করেছেন এই বলে যে, সেইসব সূফীদের মধ্যে কতিপয় সেই ত্বরীকার উপর ইস্তিকামত থাকেনি, তবে যারা থেকেছে তাঁদেরকে তিনি তাদের নিয়ত অনুযায়ী পুরস্কার দিয়েছেন।
ইমাম রাযী রহমতুল্লাহ বলেনঃ ত্বরীকার মধ্যে নতুন কোন নিয়ম যদি তৈরি করা হয়, যদি তা শরীয়তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তবে তা বিদআত নয়, বরং ইজতিহাদ। (তাফসীরে ফখরুদ্দীন রাযী)
উদাহরণঃ পূর্ববর্তী
ত্বরীকাহগুলো কীভাবে গঠিত হয়েছিল?
- চিশতিয়াঃ খাজা আবু ইসহাক চিশতী রহমতুল্লাহ (৩২১ হিজরি)
- কাদেরিয়াঃ শায়খ আবদুল কাদির জিলানী
রহমতুল্লাহ (৪৭০ হিজরি)
- নকশবন্দিয়াঃ ইমাম বাহাউদ্দীন নকশবন্দ
রহমতুল্লাহ (৭১৮ হিজরি)
→ এই সব ত্বরীকাহ নবীজী ছ্বল্লাল্লাহু য়ালাইহি ওয়া আলিহি ওয়া ছাল্লাম-এর ছুন্নাহর মূলনীতির ভিতরে থেকে তৈরি করা হয়েছে এবং তাদের সবাই শরিয়ত মান্য করে তাজকিয়া, যিকির, নূর ও ফানা-বাক্বা অর্জনের পথ তৈরি করেছেন।
উপসংহারঃ মূলত ত্বরীকাহ হলো কেবল ইবাদতের বাহ্যিক কাঠামোর পেছনে থাকা রূহানী প্রাণ। শরীয়ত হলো ছিদ্রহীন শরীর, আর ত্বরীকাহ হলো তার মধ্যে প্রবাহিত আত্মা।
✅ নতুন ত্বরীকাহ গঠন বৈধ, যদি তাঃ
- শরীয়তের বাইরে না যায়
- আহলে ছুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আক্বীদা অনুসরণ করে
- ছুন্নত কে পরিত্যাগ করে বিদআতি কোন
আমল চালু না করে।
- আধ্যাত্মিক উন্নয়ন ও নূর অর্জনের প্রকৃত মাধ্যম হয়।
আমাদের “ত্বরীকাহ আল-রাজ” কি?
ত্বরীকাহ আল-রাজ হলো এক অনন্য রূহানী পথ বা পন্থা, যার লক্ষ্য শুধুমাত্র বাহ্যিক ইবাদাতে সীমাবদ্ধ নয় বরং আত্মার গভীরে প্রবেশ করে নূরের উৎসে সংযুক্ত হওয়া। এই ত্বরীকাহর প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ রাজিব খাজা, ১৪৪৪ হিজরীর, রজব মাসের ৪ তারিখ, ২৭ জানুয়ারি ২০২৩ ঈসায়ী তথা রগ্বায়ীব শরীফে এই ত্বরীকার যাত্রা শুরু করেন। এটি পূর্ববর্তী কোনো শাজরা/ছিলছিলার অনুসারী কোন ত্বরীকাহ নয়; বরং স্বতন্ত্র আধ্যাত্মিক পথ/পদ্ধতি যা সরাসরি মহান আল্লাহ তা’য়ালার নূরের দিকে আহ্বান করে থাকেন, শাকির ও জাকির হতে।
এই ত্বরীকাহর নাম “আল-রাজ” এসেছে ত্বরীকার
ইমাম মুহাম্মদ রাজিব খাজা উনার নাম থেকে, যেখানে “রাজ” শব্দটি
উর্দু-ফারসি ঘরানায়
গোপন রহস্য ও রাজত্বের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সম্মানিত পবিত্র এই ত্বরীকাহ
আল-রাজ মূলত চারটি বিষয়কে
কেন্দ্র করে গঠিতঃ
· প্রথমত, আত্মশুদ্ধিঃ নফছকে পরিশুদ্ধ করে তাকে নফছে মুতমাইন্না বা নফছে রহমানিয়ায় উন্নীত করা।
· দ্বিতীয়ত, নূর অর্জনঃ ক্বলব ও
রূহকে নূরানী, রৌশন,
মুনাওয়্যার করে, নার তথা জাহান্নামের অন্ধকার আগুন থেকে নফছকে রক্ষা করা।
· তৃতীয়ত, মারিফাতুল্লাহঃ মহান আল্লাহ
তা’য়ালার
সত্তা, সিফাত
ও রেযামন্দি
অর্জনের অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা।
· চতুর্থত, শাকের বান্দা হওয়াঃ ইবলিসের যে চ্যালেঞ্জ ছিলো “আপনি তাদের অধিকাংশকে শাকের হিসেবে পাবেন না”, তার জবাবে এ ত্বরীকাহ একজন মুরীদকে শাকের বান্দায় রূপান্তরিত করাকেই সর্বোচ্চ সফলতা হিসেবে বিবেচনা করেন।
ত্বরীকাহ আল-রাজের রূহানী ম্যাকানিজম সম্পূর্ণ ক্বলব-নির্ভর। এই পথে ইছমে জাত “আল্লাহ” বা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” দ্বারা দায়ীমী ক্বলবী যিকিরই হচ্ছেন আত্মশুদ্ধি ও নূর লাভের মূল মাধ্যম। এই দায়ীমী জিকিরের ফলে কেবল মুখস্থ নয়, বরং মুমিনের ক্বলব সর্বক্ষণ মহান আল্লাহ তায়ালা উনার স্মরণে জেগে থাকে, যার মাধ্যমে ক্বলবে নূর সঞ্চার হয়, নফছ পরিশুদ্ধ হয় এবং কারিন ও ইবলিস শয়তান দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই ত্বরীকাহ অন্যান্য সুফি তরীকাহ থেকে ভিন্নতা ধারণ করে। যেমনঃ জান্নাত নয়, বরং মুকাররবীনদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া এখানে মূল লক্ষ্য। কেবল বাহ্যিক রুকু-সিজদাই নয়, বরং অন্তরের সংযুক্তি ও জিকরে ইলাহীতে সদা সর্বদা মশগুল থাকা এখানে মূল বিষয়। দুনিয়া/নাছুৎ এই ত্বরীকার দৃষ্টিতে ঐচ্ছিক, আর আখিরাত অপরিহার্য।
ত্বরীকাহ আল-রাজ সাতটি লতিফার
উপর ভিত্তি করে আত্মার উন্নতি সাধন করে, যথাঃ
১. লতিফা-এ-আনা (তৃতীয় নয়ন – রূহানী দর্শনের দরজা)
২. লতিফা-এ-ক্বলব
৩. লতিফা-এ-
৪. লতিফা-এ-রূহ
৫. লতিফা-এ-সির
৬. লতিফা-এ-খফি
৭. লতিফা-এ-আখফা
এই লতিফাসমূহ ধাপে ধাপে রূহানী খোলাসা ও আত্মিক তাজাল্লিয়াতের দরজা খুলে দেয়। ক্বলব লতিফা থেকেই মূলত নূর প্রবাহ শুরু হয়, যা নফছকে আলোকিত করে নফছে আম্মারা থেকে উত্তীর্ণ করে নফছে লাওয়ামা, নফছে মুলহিমা হয়ে নফছে মুতমাইন্না ও নফছে রহমানিয়ায় পৌঁছে দেয়।
এই ত্বরীকার দৈনন্দিন আমলসমূহ অত্যন্ত সুবিন্যস্ত ও বাধ্যতামূলক। এর মধ্যে রয়েছে: ফজর ও মাগরিবের পরে ত্বরীকার ছ্ববক আদায়। মহান আল্লাহ তায়ালা, রছুলে পাক ছ্বল্লাল্লাহু য়ালাইহি ওয়া আলিহি ওয়া ছাল্লাম ও মুর্শিদের মোরাকাবা, শরাহ ছ্বদরের য়া’মল, প্রতিটি নামাযের পরে ছুন্নাহ সম্মত তাছবিহ, যিকির ও দোয়া, প্রতিদিন কুরআন শরীফের (তরজমাসহ) নিদৃষ্ট কিছু আয়াত পাঠ করা, আসমাউল হুসনা পাঠ করা, ক্বারিন শয়তান থেকে বেঁচে থাকার দোয়া এবং মিনিমাম এক মিনিট হলেও দৈনিক ক্বলবী যিকির করা। এছাড়াও কিছু গোপন আমল রয়েছে, যা শুধুমাত্র যোগ্য মুরীদদের শিক্ষা দেওয়া হয়।
ত্বরীকাহ আল-রাজ এ বিশ্বাস করে, নূরই হেদায়াতের উৎস। ইবলিশ ও ক্বারিন নার দ্বারা পুষ্ট হয়, আর নূর তাদের ক্ষয় করে। তাই ক্বলবী যিকির, ইস্তিগফার ও তাজকিয়ার মাধ্যমে ক্বলব ও নফছ যখন নূরে পূর্ণ হয়, তখন সে ইবলিশ ও ক্বারিন ১০০% হেফাজতে থাকে। এই ত্বরীকাহ একজন মুরীদকে শুধু নামাজি বা রোযাদার বানায় না; বরং এমন একজন বান্দায় পরিণত করে, যার ক্বলব সর্বদা মহান আল্লাহ তা’য়ালার যিকিরে প্রাণবন্ত থাকে এবং সত্যিকারের “শাকের” বান্দায় পরিণত হয়। এভাবেই ত্বরীকাহ আল-রাজ ইবলিসের একমাত্র চ্যালেঞ্জঃ “আপনি তাদের অধিকাংশকে শাকের হিসেবে পাবেন না” তার ঐ চ্যালেঞ্জের জবাব দেয়। আর এটাই “ত্বরীকাহ আল-রাজ” এক নূরের সফর, আলমে নাছুৎ থেকে আলমে আহদিয়াত পর্যন্ত।
0 ফেইসবুক: