أَعُوْذُ بِاللّٰهِ مِنَ الشَّيْطٰانِ
الرَّجِيْمِ - بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
رَبِّ اشْرَحْ لِى صَدْرِى وَيَسِّرْ
لِىٓ أَمْرِى وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِّن لِّسَانِى يَفْقَهُوا قَوْلِى
سُبْحَانَ اللہِ وَالْحَمْدُ لِلّٰہِ وَ لآ اِلٰہَ اِلَّا اللہُ وَاللہُ اَکْبَرُ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّۃَ اِلَّا بِاللہِ الْعَلِیِّ الْعَظِیْمِ
اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَلَىٰ سَيِّدِنَا وَمَوْلَانَا مُحَمَّدٍ مَعْدَنِ الْجُوْدِ وَالْكَرَمِ وَ عَلَى آلِهٖ وَبَارِكْ وَسَلِّمْ
মসজিদে উপস্থিত সম্মানিত মুসল্লিয়ানে কেরাম সহ পর্দার অন্তরালে থাকা মা-বোনদের প্রতি (ٱلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ ٱللَّٰهِ وَبَرَكَاتُهُ) আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহ।
আজ পবিত্র ইয়াওমুল জুমু’আহ শরীফের দিন, মুমিনদের সাপ্তাহিক ঈদের দিন। আজ ১৬ই জিলক্বদ শরীফ, ১৪৪৩ হিজরি। গত সপ্তাহে আমরা খন্দক যুদ্ধের আলোচনা প্রায় শেষই করেছিলাম। আজকে এই পবিত্র যুদ্ধের পরে ইহুদি বনু কোরায়জাকে তাদের মুনাফিকির দরূন কিরূপ শাস্তি দেওয়া হয়েছিলো তার আলোচনা করবো ইন’শা-আল্লাহ।
আয়িশাহ সিদ্দিকা আলাইহাস সালাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, খন্দকের যুদ্ধে সা‘দ বিন মূ’য়াজ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু আহত হয়েছিলেন। কুরাইশ গোত্রের হিববান ইবনু আরেকা নামক এক ব্যক্তি উনার উভয় বাহুর মধ্যবর্তী রগে তীর বিদ্ধ করেছিল। নিকট থেকে উনার সেবা শুশুস্রা করার জন্য নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নাববীতে একটি তাঁবু তৈরি করেছিলেন। অতঃপর রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খন্দকের যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে যখন হাতিয়ার রেখে গোসল শেষ করলেন তখন জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম নিজ মাথার ধূলাবালি ঝাড়তে ঝাড়তে রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে হাজির হলেন এবং বললেন, আপনি হাতিয়ার রেখে দিয়েছেন, কিন্তু মহান আল্লাহ পাঁকের কসম! আমি এখনো তা রেখে দেইনি। উঠুন এবং স্বীয় সঙ্গীসাথীদের নিয়ে বনু কুরাইযাহ অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকুন। আমি অগ্রভাগে গিয়ে তাদের দূর্গসমূহে কম্পন সৃষ্টি করে তাদের অন্তরে ভয় ভীতির সঞ্চার করে দিব।’ রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-কে এ সকল কথা বলার পর জিবরাঈল আলাইহিস সালাম ফিরিশতাগণের সাথে বনু কুরাইযার দিকে যাত্রা করলেন। (সূত্র)
নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম তখন ইবনে উম্মে মাকতুম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর উপর মদীনা শরীফের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব অর্পণ করলেন এবং মাওলা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালামের হাতে যুদ্ধের পতাকা দিলেন। অতঃপর রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম মুহাজিরীন ও আনসারদের একটি সুসংগঠিত দল নিয়ে অগ্রসর হলেন এবং বনু কুরাইযাহর ‘আন্না’ নামক এক কূপের পাশে অবতরণ করলেন। অন্যান্য সাধারণ মুসলিমগণও যুদ্ধের ঘোষণা শুনে দ্রুতগতিতে বনু কুরাইযা অভিমুখে যাত্রা করলেন। পথে আসর সালাতের সময় হয়ে গেল। তখন কেউ কেউ বললেন, ‘আমাদের যেভাবে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে আমরা সেই ভাবেই কাজ করব। আমরা বনু কুরাইযাহয় গিয়ে আসর নামাজ আদায় করব।’ এ কারণে কেউ কেউ এশার পর আসর নামাজ আদায় করেন।
কিন্তু কোন কোন সাহাবা এ কথাও বলেন, ‘নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর উদ্দেশ্য এটা ছিল না যে, নামাজের ব্যাপারে আমরা অন্য মত কিংবা পথ অবলম্বন করি। বরং তিনি এটাই চেয়েছিলেন যে, বিলম্ব না করে আমরা যেন বনু কুরাইযাহর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি। যাঁরা এ ধারণা পোষণ করেছিলেন তাঁরা পথেই সময় মতো আসর নামাজ আদায় করে নিয়েছিলেন। তবে ব্যাপারটি যখন রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট পেশ করা হয় তখন তিনি এ প্রসঙ্গে কোন পক্ষকেই ভাল-মন্দ কোন কিছুই বলেন নি। (সূত্র)
যে প্রকারেই হোক বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে মুসলিম সৈন্যদল এক সময় বনু কুরাইযার ভূমিতে গিয়ে পৌঁছলেন এবং নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে মিলিত হলেন। অতঃপর বনু কুরাইযার দূর্গসমূহকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেললেন। মুসলিম বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল তিন হাজার এবং অশ্বের সংখ্যা ছিল ত্রিশটি।
বনু কুরাইযার ইহুদীগণ যখন আঁটষাট অবরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে নিপতিত হল তখন ইহুদী নেতা কা‘ব বিন আসাদ তাদের সামনে তিনটি পরিবর্তনশীল প্রস্তাব উপস্থাপন করলেণ। সেগুলো হচ্ছে যথাক্রমেঃ
হয় ইসলাম গ্রহণ করে মুহাম্মাদ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর দ্বীনে প্রবেশ করে স্বীয় জানমাল এবং সন্তান সন্ততির ধ্বংস প্রাপ্তি থেকে রক্ষা করবে, (এ প্রস্তাব উপস্থাপন কালে কা‘ব বিন আসাদ এ কথাও বলেছিলেন যে, ‘মহান আল্লাহ পাঁকের শপথ! তোমাদের নিকট এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তিনি হচ্ছেন প্রকৃতই একজন নবী এবং রাসূল। অধিকন্তু তিনি হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যার সম্পর্কে তোমরা স্বীয় মহান আল্লাহ তা’আলার কিতাবে অবগত হয়েছ।’
অথবা স্বীয় সন্তান সন্তুতিগণকে স্বহস্তে হত্যা করবে। অতঃপর তলোয়ার উত্তোলন করে মুহাম্মদ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর দিকে অগ্রসর হয়ে সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে যুদ্ধ করবে। পরিণামে হয় আমরা বিজয়ী হব, নতুবা সমূলে নিঃশেষ হয়ে যাব।
অথবা রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবা কেরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমদেরকে ধোঁকা দিয়ে শনিবার দিবস তাঁদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করবে। কারণ এ ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিন্ত থাকবেন যে, এ দিবসে কোন যুদ্ধ বিগ্রহ অনুষ্ঠিত হবে না।
কিন্তু ইহুদীগণ এ তিনটি প্রস্তাবের একটিও মঞ্জুর করল না। তার ফলে কা‘ব বিন আসাদ রাগান্বিত হয়ে বলল, ‘মায়ের কোলে জন্মগ্রহণ করার পর তোমরা কেউই একটি রাতও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অতিবাহিত করনি।
এ প্রস্তাব তিনটি প্রত্যাখ্যানের পর বনু কুরাইযাহর সম্মুখে একমাত্র যে পথটি খোলা রইল তা হল, তারা রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট অস্ত্রশস্ত্র নিক্ষেপ করে আত্মসমর্পণ করবে এবং আপন ভাগ্য নির্ধারণের ব্যাপারটি রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দেবে। কিন্তু তারা আরও ভেবে চিন্তে স্থির করল যে অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্বে অর্থাৎ অস্ত্র সমর্পণের পূর্বে তাদের সঙ্গে সাহায্য চুক্তিতে আবদ্ধ মুসলিমগণের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনা করবে। সম্ভবত এর মাধ্যমে হয়তো অস্ত্র ত্যাগের ফলাফল সম্পর্কে তারা কিছুটা ধারণা লাভ করতে সক্ষম হবে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে তারা রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এ মর্মে প্রস্তাব পাঠাল যে, ‘আবূ লুবাবা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু রদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে তাদের নিকট প্রেরণ করা হোক।’ যেহেতু আবূ লুবাবা রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গে তারা মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ ছিল সেহেতু উনার সঙ্গে তাদের পরামর্শ করা প্রয়োজন বলেই তারা মনে করেছিল। অধিকন্তু আবূ লুবাবা রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বাগ-বাগিচা, সন্তান-সন্ততি এবং গোত্রীয় লোকেরাও ছিল সেই অঞ্চলের বাসিন্দা।
যখন আবূ লুবাবা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু সেখানে উপস্থিত হলেন তখন পুরুষগণ উনাকে দেখে দৌঁড়ে উনার নিকট এলেন এবং শিশু ও মহিলাগণ করুন কণ্ঠে ক্রন্দন শুরু করলেন। অবস্থা এতো কঠিন ছিলো যা প্রত্যক্ষ করে আবূ লুবাবা রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর অন্তরে মুনাফিক চতুর ইহুদীদের প্রতি মায়ার সৃষ্টি হল। ইহুদীগণ বলল, ‘আবূ লুবাবা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু! আপনি কি যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন যে, বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আমরা মুহাম্মাদ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট অস্ত্রশস্ত্র সমর্পণ করি?’
তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’, কিন্তু তাদের প্রতি আবেগাপ্লুত থাকায় সঙ্গে সঙ্গে হাত দ্বারা কণ্ঠনালির দিকে ইঙ্গিত করলেন, যার অর্থ ছিল হত্যা। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে তিনি উপলব্ধি করলেন যে, এই মুহূর্তে তিনি যেটা করেছেন তা হাক্বিকতে মহান আল্লাহ তা’আলা এবং উনার রসূল ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সুস্পষ্ট আমানতের খিয়ানত। এ কারণে তিনি রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট না গিয়ে সরাসরি মসজিদে নববী শরীফে গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং নিজেই নিজেকে মসজিদের একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ফেলে শপথ করল যে, যতক্ষন না রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম স্বহস্তে উনাকে খুলবেন, ততক্ষন পর্যন্ত তিনি এ অবস্থাতেই থাকবেন এবং আগামীতে কোন দিন তিনি আর বনু কুরাইযার ভূমিত প্রবেশ করবেন না। এদিকে উনার প্রত্যাবর্তনে বিলম্বিত হওয়ার ব্যাপারটি রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম গভীর মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করছিলেন। অতঃপর তিনি প্রকৃত ব্যাপারটি অবগত হয়ে বললেনঃ (أَمَا إِنَّهُ لَوْ جَاءَنِيْ لَاَسْتَغْفَرْتُ لُهُ، أَمَا إِذْ قَدْ فَعَلَ مَا فَعَلَ فَمَا أَنَا بِالَّذِيْ أَطْلَقَهُ مِنْ مَكَانِهِ حِتّٰى يَتُوْبَ اللهَ عَلَيْهِ) যদি সে আমার নিকট আসত তাহলে আমি তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতাম। কিন্তু যেহেতু সে নিজের মতকে প্রাধান্য দিয়ে নিজেই এ কাজ করে বসেছে সেহেতু মহান আল্লাহ তা‘আলা যতক্ষণ না তার তওবা কবুল করছেন ততক্ষণ আমি তাকে বন্ধন মুক্ত করতে পারব না। (সূত্র)
এদিকে আবূ লুবাবা রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ইহুদীদের কাতল করা হবে মর্মে ভুলবশত দেওয়া ইঙ্গিত থাকা সত্ত্বেও বনু কুরাইযা রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট অস্ত্র সমর্পণ করারই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল এবং তিনি যা উপযুক্ত বিবেচনা করবেন তা তারা নির্বিবাদে মেনে নেবে বলে স্থির করল। অথচ দীর্ঘকাল যাবৎ এ অবরোধের ধকল সহ্য করার মতো সামর্থ্য ও সহনশীলতা বনু কুরাইযার ছিল। কারণ এক দিকে যেমন তাদের নিকট প্রচুর খাদ্য ও পানীয় মজুদ ছিল, পানির ঝরণা এবং কূপ ছিল অন্যদিকে তেমনি মজবুত ও সুসংরক্ষিত দূর্গও ছিল। পক্ষান্তরে মুসলিমগণকে উন্মুক্ত আকাশের নীচে রক্ত জমাটকারী শীত ও ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছিল এবং খন্দক যুদ্ধের প্রথমাবস্থা থেকেই অবিরাম যুদ্ধ ব্যস্ততার মধ্যে থাকার দরুন ক্লান্তির ও অবসাদের অন্ত ছিল না বললেই চলে। কিন্তু বনু কুরাইযার যুদ্ধ ছিল প্রকৃতপক্ষে আঞ্চলিক বিদ্বেষ প্রসূত এক বিরোধমূলক ব্যাপার। আর মহান আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করে দিয়েছিলেন, এর ফলে তাদের যুদ্ধোন্মাদনা এবং উদ্যম ক্রমেই স্তিমিত হয়ে পড়ছিল। তাদের ক্রমবিলীয়মান এ উদ্যম ঐ সময় শেষ সীমায় গিয়ে পৌঁছিল যখন মাওলা হযরত আলী ইবনু আবূ ত্বালিব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালাম এবং জোবায়ের বিন আউওয়াম রদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাদের দূর্গ তোরণের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম বজ্র নিনাদে ঘোষণা করলেন যে, ‘হে মহান আল্লাহ তা’আলার সেনাগণ! মহান আল্লাহ তা’আলার কসম! আমি হয় সেই অমৃতের পেয়ালা থেকে পান করব যা হামযাহ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু করেছেন আর না হয় এটা সুনিশ্চিত যে, এ দূর্গ জয় করব।’
আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালামের এ প্রাণপণ সংকল্পের কথা অবগত হয়ে বনু কুরাইযা তড়িঘড়ি করে রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর সমীপে নিজেদের সমর্পণ করে দিল যাতে তিনি তাদের জন্য যা সঙ্গত বলে বিবেচনা করবেন এরূপ একটি পন্থা অবলম্বন করেন। রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম পুরুষদের বন্দী করার নির্দেশ প্রদান করায় মুহম্মাদ বিন মাসলামা আনসারীর তত্ত্বাবধানে বনু কুরাইযাহর সকল পুরুষকে বন্দী করা হল এবং মহিলা, শিশু ও অক্ষম পুরুষদের সযত্নে পৃথকভাবে রাখা হল। আওস গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ এ বলে রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আবেদন পেশ করলেন যে, ‘বনু ক্বায়নুক্বা’ গোত্রের সঙ্গে আপনি যে আচরণ করেছেন তা আপনিই উত্তমরূপে অবগত আছেন। আপনার স্মরণ থাকতে পারে যে, ‘বনু ক্বায়নুক্বা’ গোত্র আমাদের ভাই খাযরাজ গোত্রের হালীফ ছিলেন এবং এ সকল লোকজন আমাদের হালীফ আছেন। অতএব অনুগ্রহ করে তাদের উপর ইহসান করুন।’
নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ (أَلَا تَرْضُوْنَ أَنْ يَّحْكُمَ فِيْهِمْ رَجُلٍ مِّنْكُمْ) আপনারা কি এ ব্যাপারে সন্তুষ্ট নন যে, আপনাদেরই এক ব্যক্তি তাদের সম্পর্কে মীমাংসা করে দেবেন? তারা জবাব দিলঃ (فَذٰكَ إِلٰى سَعْدِ بْنِ مُعَاذٍ) এমনটি হলে আমাদের সন্তুষ্ট না হওয়ার কোনই কারণ নেই।
রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘ভালো কথা, এ ব্যাপারটি সা‘দ বিন মু’আয রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর দায়িত্বে রইল। তারা বলল, ‘আমরা এর উপর সন্তুষ্ট আছি’। অতঃপর সা‘দ বিন মু’আয রদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে ডেকে পাঠানো হল। তিনি তখন মদীনায় অবস্থান করছিলেন। সৈন্যদের সঙ্গে বনু কুরাইযায় আগমন করা উনার পক্ষে সম্ভব হয় নি। কারণ, খন্দকের যুদ্ধে উনার হাতের শিরা কর্তিত হওয়ার ফলে তিনি আহত হয়েছিলেন। উনাকে একটি গাধার পৃষ্ঠে আরোহণ করিয়ে রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমতে হাজির করা হয়। যখন তিনি সেখানে গিয়ে পৌঁছলেন তখন গোত্রীয় লোকজন চতুর্দিকে থেকে উনাকে ঘিরে ধরে বলতে থাকলেন, ‘হে সা‘দ! রদ্বিয়াল্লাহু আনহু, স্বীয় হালীফদের সাথে উত্তম ও কল্যাণকর মীমাংসা করবেন। রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে এ জন্যই বিচারক নির্বাচিত করেছেন যে, আপনি তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবেন। কিন্তু তিনি তাদের কথার উত্তর না দিয়ে চুপচাপ রইলেন। কিন্তু লোকজন এ ব্যাপারে তাঁকে বারবার অনুরোধ জানাতে থাকলেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি বললেন, ‘এখন এমন এক সময় সমাগত যখন সা‘দ আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে কোন নিন্দুকের নিন্দার চিন্তা কিংবা ভয় করেন না। এ কথা শোনার পর কিছু লোক মদীনায় আসে এবং বন্দীদের মৃত্যু অনিবার্য বলে ঘোষণা করে।
এরপর সা‘দ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু যখন নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট পৌঁছলেন তখন তিনি ইরশাদ করলেন, (قُوْمُوْا إِلٰى سَيِّدِكُمْ) ‘তোমরা উঠে তোমাদের নেতার দিকে এগিয়ে যাও।’ যখন তাঁকে অবতরণ করিয়ে আনা হল তখন রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন, ‘হে সা‘দ! এ সব লোকজন আপনার মীমাংসার উপর আস্থাশীল হয়ে আত্মসমর্পণ করেছে।’ সা‘দ বললেন, ‘আমার মীমাংসা কি এদের উপর প্রযোজ্য হবে?’ জবাবে লোকেরা বলল, ‘জী হ্যাঁ’। তিনি বললেন, ‘মুসলিমগণের উপরেও কি?’ লোকেরা বলল, ‘জী হ্যাঁ’। তিনি আবারও বললেন, ‘এখানে যাঁরা উপস্থিত রয়েছেন তাদের উপরেও কি তা প্রযোজ্য হবে?’ তাঁর ইঙ্গিত ছিল রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম’র অবতরণ স্থানের দিকে, কিন্তু সম্মান ও ইজ্জতের কারণে মুখমন্ডল ছিল অন্যদিকে ফেরানো। প্রত্যুত্তরে রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার উপরেও হবে।’
সা’দ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘তাহলে তাদের সম্পর্কে আমার বিচারের রায় হচ্ছে এই যে, পুরুষদের হত্যা করা হোক, মহিলা ও শিশুদের বন্দী করে রাখা হোক এবং সম্পদসমূহ বন্টন করে দেয়া হোক।’
রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (لَقَدْ حَكَمْتَ فِيْهِمْ بِحُكْمِ اللهِ مِنْ فَوْقِ سَبْعِ سَمَوَاتٍ) ‘আপনি তাদের ব্যাপারে ঠিক সেই বিচারই করেছেন যেমনটি করেছেন আল্লাহ তা‘আলা সাত আসমানের উপর।’
সা’দ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু এ বিচার ছিল অত্যন্ত ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক, এবং ইহুদীদের কিতাব অনুসারেও তা ছিল উপযুক্ত। আর বনু কুরাইযা মুসলিমগণের জীবন মরণের জন্য অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতে যা করতে চেয়েছিল, তা ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ ও বিভীষিকাময়। অঙ্গীকার ভঙ্গের একটি জঘন্য অপরাধও তারা করেছিল। অধিকন্তু, মুসলিমগণকে নিঃশেষ করে ফেলার জন্য তারা দেড় হাজার তরবারী, দুই হাজার বর্শা, যুদ্ধে ব্যবহারোপযোগী তিন শত লৌহবর্ম এবং পাঁচ শত প্রতিরক্ষা ঢাল সংগ্রহ করে রেখেছিল। পরবর্তী কালে সেগুলো মুসলিমগণের অধিকারে আসে। (সূত্র)
এ সিদ্ধান্তের পর রসূলে পাঁক ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে বনু কুরাইযাহ গোত্রের লোকজনকে মদীনায় এনে বনু নাজ্জার গোত্রের হারেসের কন্যার বাড়িতে তাদের আবদ্ধ করে রাখা হয়। অতঃপর মদীনা শরীফের বাজারে একটি পরিখা খনন করে বন্দীদের এক একটি দলকে সেখানে নিয়ে গিয়ে শিরঃচ্ছেদ করা হয়। এহেন অবস্থায় নিপতিত অবশিষ্ট কিংকর্তব্যবিমূঢ় বন্দীগণ যখন স্বীয় নেতা কা‘ব বিন আসাদের নিকট জানতে চাইল যে, ‘যাদের এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাদের সঙ্গে কিরূপ আচরণ করা হচ্ছে।’
সে বলল, ‘এতটুকু উপলব্ধি করার মতো সাধারণ বোধও কি তোমাদের নেই। তোমরা কি লক্ষ্য করছ না যে, যাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তারা আর ফিরে আসছে না। কোন অনুরোধকারীর অনুরোধ রক্ষা করা হচ্ছে না। আল্লাহর শপথ! হত্যা ব্যতিরেকে আর কিছুই হচ্ছে না।’ এভাবে বন্দীদের সকলের (যাদের সংখ্যা ছয় এবং সাত শতের মধ্যবর্তী ছিল) শিরচ্ছেদ করা হয়।
উল্লেখিত ব্যবস্থাপনার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিপক্ক অঙ্গীকার ভঙ্গকারী বনু কুরাইযাহর বিশ্বাসঘাতকতা ও বিদ্রোহের সম্পূর্ণরূপে মূলোৎপাটন করে ফেলা হয়। মুসলিমগণকে নিঃশেষ করে ফেলার উদ্দেশ্যে তাঁদের দুঃখ দুর্দশা ও দারুন দুঃসময়ে শত্রুদের সাহায্য দান করে তারা যে জঘন্য যুদ্ধ অপরাধ করেছিল তাতে তারা যথার্থই প্রাণদন্ড পাওয়ার যোগ্য হয়ে গিয়েছিল। তবে এই শাস্তি মূলত কিছুই না যদি আজকে ফিলিস্থিনের দিকে যে কেউ একবার তাকায়।
বনু কুরাইযাহ গোত্রের সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্যাবলীর যখন চূড়ান্ত সমাধান হয়ে গেল তখন আল্লাহ তা’আলার নেক বান্দা সা‘দ বিন মু‘আয রদ্বিয়াল্লাহু আনহু যে দোয়া মহান আল্লাহ তা’আলার দরবারে করেছিলেন তা কবুল যে হয়েছে তা প্রকাশের সময় এসে গেল যা আজকের আলোচনায় শুরুতেই করা হয়েছে। উনার ক্ষত বিদীর্ণ হয়ে গেল। ঐ সময় তিনি মসজিদে নাবাবীতে অবস্থান করছিলেন। উনার বিদীর্ণ ক্ষতস্থান থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে। একিই মসজিদে বনু গিফার গোত্রের লোকজনের কয়েকটি তাবুও ছিল। যেহেতু তাদের দিকে রক্ত বয়ে যাচ্ছিল, তাই তারা তা দেখে বললেন, ‘ওহে তাবু ওয়ালা! হে তাঁবুবাসীগণ! আপনাদের দিক থেকে এসব কী আসছে আমাদের দিকে? পরে তাঁরা জানলেন যে, সা‘দ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আর এ জখমের কারণেই তিনি মারা যান, মহান আল্লাহ তা’আলা উনার উপর সন্তুষ্ট থাকুন। (সূত্র)
বুখারী এবং মুসলিম শরীফে জাবির রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, রসূলে পাঁক ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেনঃ (اِهْتَزَّ عَرْشُ الرَّحْمٰنِ لِمَوْتِ سَعْدِ بْنِ مُعَاذٍ) সা‘দ বিন মু’আয রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মৃত্যুতে মহান আল্লাহ তা‘আলার আরশ কেঁপে উঠল। (সূত্র) ইমাম তিরমিযী রহমতুল্লাহ আনাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং যা বিশুদ্ধ বলে সাব্যস্ত করেছেন যে, যখন সা‘দ বিন মু’আয রদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর জানাযা উঠানো হলে মুনাফিক্বগণ বলল, ‘এর লাশ কতই না হালকা। রাসূল কারীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ (إِنَّ الْمَلَائِكَةَ كَانَتْ تَحْمِلُهُ) মহান আল্লাহ তা’আলার ফিরিশতাগণ উনার লাশ উত্তোলন করেছিলেন। (সূত্র)
বনু কুরাইযাহর অবরোধ কালে একজন মুসলিম শহীদ হন। তাঁর নাম ছিল খাল্লাদ বিন সুওয়াইদ। তিনি ছিলেন সে সাহাবী যাঁর উপর বনু কুরায়যার এক স্ত্রীলোক যাঁতার একটি পাট নিক্ষেপ করেছিল। এছাড়া হযরত উকাশার ভাই আবূ সিনান বিন মিহসান এ অবরোধকালে মৃত্যু বরণ করেন।
যতদূর জানা যায় আবূ লুবাবা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ছয় রাত্রি পর্যন্ত খুঁটির সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় সময় অতিবাহিত করেন। প্রত্যেকবার নামাজের সময় উনার স্ত্রী এসে বাঁধন খুলে দিতেন। নামাজ শেষে পুনরায় তিনি খুঁটির সঙ্গে নিজেকে বেঁধে ফেলতেন। অতঃপর এক প্রত্যুষে উনার তওবা কবুল সম্পর্কে রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর ওহী নাযিল হয়। সে সময় নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম উম্মু সালামাহ আলাইহাস সালামের ঘরে অবস্থান করছিলেন। আবূ লুবাবা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে, উম্মু সালামাহ আপন গৃহের দরজায় দাঁড়িয়ে আমাকে বললেন, ‘হে আবূ লুবাবা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু! শুভ সংবাদ, সন্তুষ্ট হয়ে যাও, মহান আল্লাহ তা‘আলা আপনার তওবা কবুল করেছেন। এ কথা শ্রবণ করে উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম (রদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) উনার বাঁধন খুলে দেয়ার জন্য দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু রসূলে পাঁক ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া অন্য কারো হাতে বাঁধন খুলে নিতে তিনি অস্বীকার করলেন। তাই ফজরের নামাজের জন্য বাহির হয়ে নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম যখন সেখানে দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন উনার বাঁধন খুলে দেন।
আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর পূর্বে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয় আজকের এই মাসেই। পঁচিশ দিন পর্যন্ত বনু কুরাইযাহর অবরোধ স্থায়ী থাকে। আল কুরআনের সূরাহ আহযাবে মহান আল্লাহ তা‘আলা খন্দকের যুদ্ধ এবং বনু কুরাইযাহর যুদ্ধ সম্পর্কে অনেক আয়াত অবতীর্ণ করেন এবং এ দু’ যুদ্ধের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করেন। মু’মিন ও মুনাফিক্বদের বিভিন্ন অবস্থার বিস্তারিত বিবরণ এতে পাওয়া যায়। সূরাহ আহযাবের এ বিষয় সংশ্লিষ্ট আয়াতে কারীমাসমূহে শত্রুদের বিভিন্ন দলের ভাঙ্গন ও উদ্যমহীনতা এবং আহলে কিতাবের অঙ্গীকার ভঙ্গের ফলাফল সম্পর্কে সুস্পষ্ট আলোকপাত হয়। যারা বিস্তারিত জানার আগ্রহ রাখেন তারা সেইসব অধ্যায়নের চেষ্টা করবেন বলে আশা রাখি।
এছাড়াও এই পবিত্র মাসেই বিখ্যাত হুদাইবিয়ার সন্ধি ও বাইয়াতে রিদ্বওয়ান অনুষ্টিত হয়েছিল। ইন’শা-আল্লাহ আগামী সপ্তাহে বিস্তারিত আলোচনা করবো এই বিষয়ে যদি আল্লাহ পাঁক তৌফিক দান করেন। আর প্রতি সপ্তাহের মতো আজকেও সবাইকে আহ্বান করছি, অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হবে জুমু’আহ শরীফের খুৎবা, আর খুৎবার আযান থেকে শুরু করে নামায চলাকালীন সময়ে করা সকল হালাল ব্যবসাই মহান আল্লাহ পাক নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন, মহান আল্লাহ পাক বলেনঃ (یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا نُوۡدِیَ لِلصَّلٰوۃِ مِنۡ یَّوۡمِ الۡجُمُعَۃِ فَاسۡعَوۡا اِلٰی ذِکۡرِ اللّٰهِ وَ ذَرُوا الۡبَیۡعَ ؕ ذٰلِکُمۡ خَیۡرٌ لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ) হে ঈমানদারগণ! (পবিত্র) জুমু’আহ শরীফের দিনে যখন নামাযের জন্য (তোমাদের) আহবান করা হয় (অর্থাৎ যখন আযান দেওয়া হয়), তখন তোমরা মহান আল্লাহ তা’য়ালার স্মরণের দিকে (অর্থাৎ নামাযের উদ্যেশ্যে মসজিদের দিকে) ধাবিত হও। এবং (সকল ধরণের) বেচা-কেনা পরিত্যাগ কর, এটাই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম, যদি তোমরা বুঝতে পারো। (সূরাহ জুমু’আহ শরীফ ৬২/৯)।
কুরআনের এই আয়াত দ্বারা জুমু’আহ শরীফের দিন খুৎবার আযানের সময় থেকে নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত সকল ধরণের ব্যবসা বাণিজ্যকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, তাই এই সময় দোকানপাঠ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে, ব্যবসা প্রতিষ্টানে তালা মেরে নামাযে উপস্থিত হতে হবে। এই সময় বেচাকেনা হারাম, আমাদের ফিকির করা উচিৎ যে, মাত্র আধা ঘন্টার জুমু’আহ নামাযের সময় আমরা কি এমন বেচাকেনা করছি, কি এমন লাভ করছি যে সামান্য কিছু টাকার জন্য সমস্ত উপার্জনটাই হারাম করে দিচ্ছি, কারণ ঐ মুহূর্তে করা এক টাকার ব্যবসাও বাকি টাকার সাথে মিলে সম্পূর্ণ টাকাই হারাম করে দিচ্ছে। আর হারাম উপার্জনে কখনোই মহান আল্লাহ তা’য়ালার বরকত থাকেনা, যার কারণে দিনশেষে দেখা যায় সারাদিন খেঁটেও ফায়দা হচ্ছেনা।
এর পরের আয়াতে মহান আল্লাহ পাক বলেনঃ (فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلٰوةُ فَانتَشِرُوا فِى الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِن فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ) অতঃপর নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে (অর্থাৎ জমিনে) ছড়িয়ে পড় এবং মহান আল্লাহ তা’য়ালার অনুগ্রহ (অর্থাৎ জীবিকা) তালাশ কর এবং মহান আল্লাহ তা’য়ালাকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা (জীবিকা উপার্জনে) সফলকাম হও। (সূরাহ জুমু’আহ শরীফ ৬২/১০)।
আয়াতে পাকে, মহান আল্লাহ তা’য়ালা যে অনুগ্রহ তালাশের কথা বলেছেন, এর অর্থ দুনিয়াবি কাজ-কর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্য আবার শুরু করো। অর্থাৎ, জুমু’আর নামায শেষ করার পর তোমরা পূনরায় নিজ নিজ কাজে-কামে এবং দুনিয়ার ব্যস্ততায় লেগে যাও। তবে আমার স্মরণ থেকে গাফেল হয়োনা, বরং মনে মনে আমার যিকির করো আর কাজ কাম করতে থাকো। এছাড়াও একটি বিষয় পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, জুমু’আহ শরীফের দিন কাজ-কর্ম বন্ধ রাখা জরুরী নয়। কেবল নামাযের জন্য, নামাযের সময় তা বন্ধ রাখা জরুরী। মহান আল্লাহ পাক-এর এরূপ স্পষ্ট হুকুম জানার পরেও যারা এই হুকুম অমান্য করে ব্যবসা করবেন তারা ইচ্ছা অনিচ্ছা আর অজ্ঞতায় নিজেদের হালাল মালের মধ্যে হারাম কে মিশিয়ে দেবেন। আর হারাম মালের সংমিশ্রণের রিযিক দ্বারা গঠিত দেহ কখনোই জান্নাতে যাবেনা।
এছাড়াও যারা নিয়মিত নামায পড়েন, জুমু’আতে আসেন, তারা যেনো সুন্নাহ অনুসরণ করেই মসজিদে আসেন, এতে রহমত ও বরকতপ্রাপ্ত হবেন, শাওয়ার বা পুকুরে এক ডুইব দিয়েই যেকোন একটা পোশাক পরে জুমু’আর দুই রাকাত ফরজ নামায আদায়ের উদ্যেশে মসজিদে না এসে ভালো মতো প্রিপারেশন নিয়েই আসবেন। হাদিস শরীফে হযরত, (عَنْ سَلْمَانَ الْفَارِسِيّ رَضِیَ اللّٰہُ عَنۡہُ، قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ آلِهٖ وَسَلَّمَ لاَ يَغْتَسِلُ رَجُلٌ يَوْمَ الْجُمُعَةِ، وَيَتَطَهَّرُ مَا اسْتَطَاعَ مِنْ طُهْرٍ، وَيَدَّهِنُ مِنْ دُهْنِهِ، أَوْ يَمَسُّ مِنْ طِيبِ بَيْتِهِ ثُمَّ يَخْرُجُ، فَلاَ يُفَرِّقُ بَيْنَ اثْنَيْنِ، ثُمَّ يُصَلِّي مَا كُتِبَ لَهُ، ثُمَّ يُنْصِتُ إِذَا تَكَلَّمَ الإِمَامُ، إِلاَّ غُفِرَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ الأُخْرَى) “সালমান ফারসী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যাক্তি জুমু’আর দিন গোসল করে এবং যথাসাধ্য ভালরূপে পবিত্রতা অর্জন করে এবং নিজের তেল থেকে ব্যবহার করে বা নিজ ঘরের সুগন্ধি ব্যবহার করে এরপর (নামাযের উদ্যেশ্যে) বের হয় এবং (মসজিদে প্রবেশ করে) দু’জন লোকের মাঝে ফাঁক না করে (যেখানে যায়গা পায় সেখানেই দাড়িয়ে যায়), অতঃপর তার নির্ধারিত নামায আদায় করে এবং ইমামের খুতবা দেওয়ার সময় চুপ থাকে, তা হলে তার সেই জুমু’আহ শরীফের (নামায) থেকে পরের জুমু’আহ শরীফের (নামাযের আগ) পর্যন্ত (মধ্যবর্তী) সময়ের (মধ্যে ঘটা) যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। (বুখারী শরিফঃ ইঃফাঃ ৮৩৯, আঃনাঃ ৮৮৩)
জুমু’আ শরীফের দিনকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নাই, না আছে সুযোগ জুমু’আর নামায কে অবহেলার। হদিস শরীফে এসেছেঃ (عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ خَطَبَنَا رَسُولُ اللَّهِ ـ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ آلِهٖ وَسَلَّمَ ـ فَقَالَ " يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إِلَى اللَّهِ قَبْلَ أَنْ تَمُوتُوا وَبَادِرُوا بِالأَعْمَالِ الصَّالِحَةِ قَبْلَ أَنْ تُشْغَلُوا وَصِلُوا الَّذِي بَيْنَكُمْ وَبَيْنَ رَبِّكُمْ بِكَثْرَةِ ذِكْرِكُمْ لَهُ وَكَثْرَةِ الصَّدَقَةِ فِي السِّرِّ وَالْعَلاَنِيَةِ تُرْزَقُوا وَتُنْصَرُوا وَتُجْبَرُوا وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ قَدِ افْتَرَضَ عَلَيْكُمُ الْجُمُعَةَ فِي مَقَامِي هَذَا فِي يَوْمِي هَذَا فِي شَهْرِي هَذَا مِنْ عَامِي هَذَا إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ فَمَنْ تَرَكَهَا فِي حَيَاتِي أَوْ بَعْدِي وَلَهُ إِمَامٌ عَادِلٌ أَوْ جَائِرٌ اسْتِخْفَافًا بِهَا أَوْ جُحُودًا بِهَا فَلاَ جَمَعَ اللَّهُ لَهُ شَمْلَهُ وَلاَ بَارَكَ لَهُ فِي أَمْرِهِ أَلاَ وَلاَ صَلاَةَ لَهُ وَلاَ زَكَاةَ لَهُ وَلاَ حَجَّ لَهُ وَلاَ صَوْمَ لَهُ وَلاَ بِرَّ لَهُ حَتَّى يَتُوبَ فَمَنْ تَابَ تَابَ اللَّهُ عَلَيْهِ أَلاَ لاَ تَؤُمَّنَّ امْرَأَةٌ رَجُلاً وَلاَ يَؤُمَّنَّ أَعْرَابِيٌّ مُهَاجِرًا وَلاَ يَؤُمَّ فَاجِرٌ مُؤْمِنًا إِلاَّ أَنْ يَقْهَرَهُ بِسُلْطَانٍ يَخَافُ سَيْفَهُ وَسَوْطَهُ) হযরত জাবির ইবনু আবদুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি বলেনঃ হে মানবমন্ডলী! তোমরা মরার পূর্বেই মহান আল্লাহ পাকের নিকট তওবা করো এবং কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ার পূর্বেই সৎ কাজের দিকে দ্রুত ধাবিত হও। তাঁর অধিক যিকরের মাধ্যমে তোমাদের রবের সাথে তোমাদের সম্পর্ক স্থাপন করো এবং গোপনে ও প্রকাশ্যে অধিক পরিমাণে দান-খয়রাত করো, এজন্য তোমাদের রিযিক বাড়িয়ে দেয়া হবে, সাহায্য করা হবে এবং তোমাদের অবস্থার সংশোধন করা হবে।
তোমরা জেনে রাখো, নিশ্চয় মহান আল্লাহ তাআলা আমার এই স্থানে আমার এই দিনে, আমার এই মাসে এবং আমার এই বছরে তোমাদের উপর কিয়ামতের দিন পর্যন্ত জুমু’আর নামাযকে ফরয করেছেন। অতএব যে ব্যক্তি আমার (মুবারক) জিন্দেগীতে বা আমার প্রস্থানের পরে, ন্যায়পরায়ণ অথবা যালেম শাসক থাকা সত্ত্বেও জুমু’আর নামাযকে তুচ্ছ মনে করে বা অস্বীকার করে তা বর্জন করবে, মহান আল্লাহ পাক তার বিক্ষিপ্ত বিষয়কে একত্রে গুছিয়ে দিবেন না (অর্থাৎ তার দুনিয়াবি জঞ্জালগুলি আরো জগাখিচুড়ী হয়ে যাবে) এবং তার কাজে-কর্মে বরকত দান করবেন না। নাউযুবিল্লাহ!
(অতএব) সাবধান! তার সালাত, যাকাত, হাজ্জ (হজ্জ), সাওম (রোযা) এবং অন্য কোন নেক আমল গ্রহণ করা হবে না, যতক্ষণ না সে তওবা করে। যে ব্যক্তি তওবা করে, মহান আল্লাহ তাআলা তার তওবা কবূল করেন। সাবধান! কোনো নারীকে পুরুষের ওপর ইমাম নিযুক্ত করবেনা, কোনো বেদুইনকে কোনো মুহাজিরের ওপর ইমাম নিযুক্ত করবেনা, কোনো খারাপ ব্যক্তিকে কোনো (সত্যিকার) মুমিনের ওপর ইমাম নিযুক্ত করবেনা। তবে কোন স্বৈরাচারী শাসক যদি বাধ্য করে এবং তার তরবারি ও চাবুকের ভয় থাকে তাহলে তা স্বতন্ত্র কথা। (ইবনে মাজাহ শরীফঃ ১০৮১)
মহান আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে পবিত্র জুমু’আহ শরীফ সহ দৈনিক ৫ ওয়াক্ত নামায জামায়াতে আদায়ের তৌফিক দিন, জামায়াতে না পারলেও অন্তত একা আদায়ের তৌফিক যেনো দেন, এই আর্জি পেশ করলাম মালিক মহান রব্বুল আলামিনের দরবারে। আল ফাতিহা (সূরাহ ফাতিহা দিয়ে দোয়া শেষ করবেন।)
0 ফেইসবুক: