Monday, August 8, 2022

আপনি কি অগণিত নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করছেন, নাকি এখনো গাফেলই আছেন?

মহান আল্লাহ তা’আলার নিয়ামত ও অনুগ্রহ ছাড়া মানুষের বা কোনো প্রাণীর পক্ষে এক মুহূর্তও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মানুষ  মহান আল্লাহ তা’আলার অগণিত নিয়ামত ভোগ করা সত্ত্বেও এ নিয়ামতের উপযুক্ত শুকরিয়া আদায় করে না। অথচ মানুষের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল নিয়ামত একমাত্র মহান আল্লাহ তা’আলাই তাদের দিয়ে থাকেন, বিনিময়ে তারা ভাবে আমরা তো দৈনিক নামায রোজা করেই যাচ্ছি আর কিভাবে শুকরিয়া আদায় করবো? অথচ দ্বীন তো কেবল নামায রোজাই না, বরং মহান আল্লাহ তা'আলার নিয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের অর্থ হচ্ছে উনার সকল আদেশাবলি যথাযথভাবে মেনে চলা। অথচ বেশির ভাগ মানুষই মহান আল্লাহ তা'আলার শুকরগুজার না করে প্রতিনিয়ত মহান আল্লাহ তা'আলার অবাধ্যতায় লিপ্ত অথচ এরাও নামায রোজা করে।

উদাহরণস্বরূপ, জামায়াতে নামায রোজা করা মানুষটাও, প্রেম ভালোবাসা নামক জিনায় লিপ্ত, লিপ্ত সুদের মতো নিকৃষ্ট বিষয়ে, লিপ্ত ঘোষ নামক হারামে, লিপ্ত গীবত পরনিন্দা, পরচর্চায়। অথচ এই মানুষগুলি বুঝেনা যে মহান আল্লাহ তা'আলা যে মানুষকে নিয়ামত দান করেছেন তা কিন্তু সীমাহীন। এমন অনেক নিয়ামতও আছে যেগুলোর খবর মানুষ জানেই না। পবিত্র আল কুরআনে মহান আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ (وَ اِنۡ تَعُدُّوۡا نِعۡمَتَ اللّٰهِ لَا تُحۡصُوۡهَا ؕ اِنَّ الۡاِنۡسَانَ لَظَلُوۡمٌ کَفَّارٌ) ‘যদি তোমরা মহান আল্লাহ তা'আলার নিয়ামতগুলো গণনা করতে থাকো, তাহলে সেগুলো পুরোপুরি গণনা করতেও পারবে না। অবশ্যই মানুষ অতি মাত্রায় যালিম (ও) অকৃতজ্ঞ। (আল কুরআন ১৪/৩৪)

অর্থাৎ মহান আল্লাহ তা'আলার নিয়ামত এত অধিক যে, সবাই মিলে গণনা করতে চাইলে গুণে শেষ করা যাবে না। মানুষের নিজের অস্তিত্বই স্বয়ং একটি ক্ষুদ্র জগত। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, হস্ত, পদ, দেহের প্রতিটি গ্রন্থি এবং শিরা-উপশিরায় মহান আল্লাহ তা'আলার অন্তহীন নিয়ামত নিহিত রয়েছে। (ফাতহুল ক্বদির) এ থেকে অনুমান করা যায় যে, মহান আল্লাহ তা'আলার সম্পূর্ণ দান ও নিয়ামতের সংক্ষিপ্ত বা বিস্তারিত কোনোভাবেই আমরা গণনা করে শেষ করতে পারব না। এই অসংখ্য নিয়ামতের বিনিময়ে অসংখ্য ইবাদত ও অসংখ্য শোকর জরুরি হওয়াই ছিল ইনসাফের দাবি। মানুষ সে শোকর আদায়ের ব্যাপারে অতিশয় জালেম, কারণ সে এ ব্যাপারে গাফেল (অজ্ঞ) থাকে। (ফাতহুল ক্বদির)

আর এসব নিয়ামতের বিষয়ে মহান আল্লাহ তা'আলার কাছে সবাইকে জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে। এ বিষয়ে মহান মহান আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ (ثُمَّ لَتُسۡـَٔلُنَّ یَوۡمَئِذٍ عَنِ النَّعِیۡمِ) এরপর সেদিন (শেষ বিচারে) অবশ্যই তোমাদেরকে (যা কিছু দেয়া হয়েছে এমন সব) নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।’ (আল কুরআন ১০২/৮)

অর্থাৎ তোমরা সবাই কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তা'আলা প্রদত্ত নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে যে, সেগুলোর শোকর আদায় করেছ কি না, সেগুলোতে মহান আল্লাহ তা'আলার হক আদায় করেছ কি না; নাকি পাপকাজে ব্যয় করেছ? এতে সব প্রকার নিয়ামত এসে যায়। কুরআন ও হাদিসের অন্যত্র এরকম কিছু নিয়ামতের উদাহরণ দেয়া হয়েছে। অন্য আয়াতে এভাবে বলা হয়েছেঃ (وَ لَا تَقۡفُ مَا لَیۡسَ لَکَ بِهٖ عِلۡمٌ ؕ اِنَّ السَّمۡعَ وَ الۡبَصَرَ وَ الۡفُؤَادَ کُلُّ اُولٰٓئِکَ کَانَ عَنۡهُ مَسۡـُٔوۡلًا) আর যে বিষয় তোমার জানা নাই তার অনুসরণ করো না। নিশ্চয় কান, চোখ, হৃদয় এদের প্রত্যেকটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে। (আল কুরআন ১৭/৩৬) এতে মানুষের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও হৃদয় সম্পর্কিত লাখো নেয়ামত অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, যেগুলো মানুষ প্রতিটা মুহূর্তে ব্যবহার করে যাচ্ছে।

বিভিন্ন হাদিসেও নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হওয়ার কথা স্পষ্টভাবে এসেছে। যেমন রসুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ দুটি নেয়ামত এমন আছে যেগুলোর বিষয়ে বেশির ভাগ মানুষই (ইবলিশ কতৃক) প্রতারিত হয়। তার একটি হলো স্বাস্থ্য, অপরটি হচ্ছে অবসর সময়। (বুখারি শরীফ ৬৪১২)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, একবার রসুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম ক্ষুধায় কাতর হয়ে বের হলেন, পথে আবু বকর সিদ্দিক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু আলাইহিস সালাম ও উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু আলাইহিস সালামও বের হলেন, রসুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম উনাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কেন বের হয়েছ? উনারা বললেন, ক্ষুধা। রসুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘যার হাতে আমার নফস উনার শপথ, আমিও সে কারণেই বের হয়েছি। তারপর তিনি বললেন, চলো। উনারা সবাই এক আনসারী সাহাবীর বাড়িতে আগমন করলেন। আনসার সাহাবীর স্ত্রী রসুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম ও উনার সাথীদের দেখে বেজায় খুশি হলেন, তিনি শুভেচ্ছা ও স্বাগতম জানানোর মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানালেন। রসুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার আহাল কোথায়? স্ত্রী জানালেন যে, তিনি সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে গেছেন। এ কথা বলতে বলতে আনসার সাহাবী এসে উনাদের সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ! আজ কেউ আমার মতো মেহমান পাবে না। তখন উনারা বসলে তিনি তাদের জন্য এক কাঁদি খেজুর নিয়ে এলেন যাতে কাঁচা-পাকা, আধাপাকা, ভালো-মন্দ সব ধরনের খেজুর ছিল। তারপর আনসার সাহাবী ছুরি নিয়ে দৌড় দিলেন ছাগলের পালের দিকে। রসুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সাবধান! দুধ দেয় এমন কোন ছাগল জবাই করো না। আনসারী সাহাবী উনাদের জন্য ছাগল জবাই করলেন, এবং উনাদের আপ্যায়ন করালেন, উনারা ছাগলের গোশত খেলেন, খেজুর গ্রহণ করলেন, পানি পান করলেন। তারপর যখন (খাবার খেয়ে) তৃপ্ত হলেন তখন রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু আলাইহিস সালাম ও উমর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু আলাইহিস সালামকে বললেন, তোমরা কিয়ামতের দিন এ সমস্ত নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। তোমাদেরকে ক্ষুধা তোমাদের ঘর থেকে বের করলো, তারপর তোমরা এমন নেয়ামত ভোগ করার পর ফিরে গেলে।’ (মুসলিম শরীফ ২০৩৮)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, এ আয়াত নাজিল হলে যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, হে মহান আল্লাহ তা’আলার রসূল ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম! আমরা কোন (কোন) নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবো? এটা তো শুধু (আসওয়াদান বা দুই কালো জিনিস) খেজুর ও পানি। রসূল ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বললেন, অবশ্যই তা সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (তিরমিজি শরীফ ৫/৪৪৮, ইবনে মাজাহ শরীফ ৪১৫৮, মুসনাদে আহমাদ ৩/২৪) অন্য বর্ণনায় এসেছে, রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন প্রথম যে নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে তা হচ্ছে, ‘আমি কি তোমাকে শারীরিকভাবে সুস্থ করিনি? আমি কি তোমাকে সুপেয় পানি পান করাইনি?’ (তিরমিজি শরীফ ৩৩৫৮) অন্য বর্ণনায় এসেছে, রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মহান আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন বলবেন, আদম সন্তান! তোমাকে ঘোড়া ও উটে বহন করিয়েছি, তোমাকে স্ত্রীর ব্যবস্থা করে দিয়েছি, তোমাকে ঘুরাফিরা ও নেতৃত্ব করার সুযোগ দিয়েছি, এগুলোর কৃতজ্ঞতা কোথায়? (মুসলিম শরীফ ২৯৬৮, মুসনাদে আহমাদ ২/৪৯২)

উপরের বর্ণনা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুধু কাফেরদের নয় বরং সৎ মুমিনদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সুতরাং সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহ তা’আলার আনুগত্যের মাধ্যমে উনার নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা উচিত। যাতে করে মহান আল্লাহ তা’আলার নিকট হিসাব দেয়া সহজ হয়, কারণ মহান আল্লাহ পাঁক স্পষ্ট বলেই দিয়েছেনঃ (اَحَسِبَ النَّاسُ اَنۡ یُّتۡرَکُوۡۤا اَنۡ یَّقُوۡلُوۡۤا اٰمَنَّا وَ هُمۡ لَا یُفۡتَنُوۡنَ) মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে, আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? (আল কুরআন ২৯/২)

তাই আসুন আল্লাজির শুকরিয়া আদায় করি দুনিয়া থেকে আখিরাতের দিকে নিজেকে ধাবিত করে, উনার স্বরনে যিকির ফিকিরে নিজেকে নিয়োজিত করে, নতুবা আখেরাত হবে বড়োই ভয়ঙ্কর।


সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুনঃ

এডমিন

আমার লিখা এবং প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা সম্পূর্ণ বে আইনি।

0 ফেইসবুক: