সম্মানিত দ্বীন ইসলামের অন্যতম একটি ফরয হচ্ছে পর্দা করা। কিন্তু বর্তমানে তথাকথিত নামধারী মুসলমানরা পর্দা করার ব্যপারে কোনো গুরুত্বই দিচ্ছে না। বিশেষ করে যারা পর্দা করতে মানুষকে উৎসাহ দিবে, সেই আলিম-উলামারাই পর্দা করছে না। নাউযুবিল্লাহ! নাউযুবিল্লাহ!
আজকাল দেখা যাচ্ছে বোনেরা পর্দা তো করছেইনা, উল্টো মনের পর্দা বড় পর্দা বলে বুলি আওড়াচ্ছে, অথচ পর্দা যাদের উপর প্রথম নাযিল হয়েছিলো এই বলেঃ (یٰۤاَیُّهَا النَّبِیُّ قُلۡ لِّاَزۡوَاجِکَ وَ بَنٰتِکَ وَ نِسَآءِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ یُدۡنِیۡنَ عَلَیۡهِنَّ مِنۡ جَلَابِیۡبِهِنَّؕ ذٰلِکَ اَدۡنٰۤی اَنۡ یُّعۡرَفۡنَ فَلَا یُؤۡذَیۡنَ ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا) হে নবী ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম, আপনি আপনার আহলিয়াগণকে, কন্যাদেরকে ও মুমিনা নারীদেরকে বলুন, (যখন তারা বাড়ীর বাহিরে বের হয়, তখন) “তারা যেন তাদের জিলবাব-এর একটি অংশ নিজেদের (চেহারার) উপর ঝুলিয়ে দেয়, (তাহলে) তাদেরকে (মুমিনা নারী হিসেবে) চেনা সহজতর হবে এবং তাদেরকে (খারাপ পুরুষ কতৃক) উত্যক্ত করা হবে না। আর মহান আল্লাহ তা’আলা (হলেন) অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (আল কুরআন ৩৩/৫৯)
উম্মাহাতুল মু'মিনিন আলাইহিন্নাস সালাম উনারা ছিলেন সমস্থ উম্মতের মাতাঃ (وَ اَزۡوَاجُهٗۤ اُمَّهٰتُهُمۡ) (অর্থাৎ নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম)-এর আহলিয়াগণ হলেন মুমিনদের মায়ের অনুরূপ। (আল কুরআন ৩৩/৬) যাদের সাথে বিয়ে হারাম ছিলো উম্মতের জন্য, এবং উনারা ছিলেন আগা গোঁড়া পাঁক পবিত্রা (আল কুরআন ৩৩/৩৩) অনুসারে এর পরেও উনাদের বলা হচ্ছে তোমাদের দ্বীনি সন্তানদের সাথেও পর্দা করতে হবে।
এখন কি আমার সেই বোনেরা এটা মনে করে যে নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের সহধর্মিণী যারা উম্মতের মা হিসেবে আল্লাহ তা’আলা কতৃক সাব্যস্থ উনাদের মনের চেয়েও তাদের মন বেশি পাঁক পবিত্র? বা কখনো কোন মহিলার পক্ষে উনাদের মতো পাঁক পবিত্র মনের অধিকারী হওয়া সম্ভব? যে বোনটি বেপর্দা থাকার জন্য মনের পর্দা বড় পর্দা বলে বুলি আওড়ায় মুসলিম হয়ে, সে কি নিজেকে উম্মুল মুমিনিন আয়েশা সিদ্দিকা আলাইহাস সালাম থেকেও পবিত্র মনের অধিকারী বলে মনে করে? অথচ উনাকেও পর্দা করতে হয়েছে, কারণ এটা ছিলো সরাসরি মহান আল্লাহ তা'আলার হুকুম। আর মুমিনা কখনো আল্লাজীর হুকুমের বিপরীতে গিয়ে, কিয়ামতের মাঠে সূরাহ লাহাবে বর্ণিত উম্মে জামিল অরফে আরওয়া লানতুল্লাহি আলাইহার সাথে দাঁড়াতে চাইবেনা।
প্রথমেই আমাদের যে জিনিসটা বুঝতে হবে তা হচ্ছে পর্দা করার ব্যপারে হুকুম দিয়েছেন স্বয়ং মহান আল্লাহ তাআলা। হুকুমের হেতু যাই হোকঃ হুকুম, “জান্নাতি হুরের চেহারা ওয়ালা কোন বোনই হোন কিংবা আফ্রিকান কোন কৃষ্ণাঙ্গ অনাকর্ষণীয় বোনই হোন, এমনকি এসিডে ঝলসে যাওয়া কোন ক্ষতবিক্ষত চেহারার অধিকারী বোন হলেও, সবার ক্ষেত্রে হুকুম এক সমান। আর মহান আল্লাহ তা’আলার নিকট মুমিনার মাপকাঠি হচ্ছে বাহিরে যখন তাঁরা বের হবে বা পর পুরুষের সম্মুখে যাবে, তখন তাঁরা নিজেদের ভালো মতো ঢেকে ফেলবে, এতে কেবল পর্দাই হবেনা, সাথে তাদের সামাজিক অবস্থানও পরিষ্কার হয়ে যাবে, আর কেউ তাদের উত্যক্তও করবেনা বলে গ্যারান্টি দিয়েছেন মহান আল্লাহ পাঁক। আর মহান আল্লাহ পাঁক এটাই পছন্দ করেন। আপনি পর্দা পছন্দ করুন বা না করুন, যদি মহান আল্লাহ পাঁক উনাকে খুশি করতে চান, তাহলে আপনার ইচ্ছা, আপনার মনের, নফসের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও তা করতে হবে। আর এটাই মহান আল্লাহ পাঁক আল কুরআনের সূরাহ আহযাবের ৩৩/৫৯ এ নির্দেশ দিয়েছেন।
মনে রাখতে হবে, পর্দা করা ফরজ, আর বেপর্দা হওয়া জিনার অন্তর্ভুক্ত, কেবল নিজের জিনাই না, বেপর্দা মেয়েদের কারণে দৈনিক কোটি কোটি পুরুষ জিনার গুনাহের ভাগিদার হয়। এর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুনঃ (জিনা-ব্যবিচার সম্পর্কে কুরআন সুন্নাহ’র হুকুম আহকাম এবং দুনিয়া ও আখেরাতের শাস্তি)।
এজকন নারীর পক্ষে কস্মিনকালেও মুমিনা হওয়া সম্ভব না যদিনা সে খাসভাবে পর্দা করে থাকে। তার আমল আর দ্বীনি এক্টিভিটিস যাই হোক, পর্দা বিহীন মুত্তাকী পরহেজগার হওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব। আর মহান আল্লাহ তা’আলা একেবারে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলে দিয়েছেন, কার সাথে পর্দা করতে হবে, তাও কতটুকু।
আর শুধু নারিই না, বরং পুরুষদেরও পর্দার হুকুম দিয়েছেন মহান আল্লাহ পাঁক, তবে তাদের চেহারা ঢাকার নির্দেশ না দিলেও দৃষ্টির উপর দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ তাআলা বলেনঃ মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে; এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্রতার বিষয়। নিশ্চই তারা যা করে, মহান আল্লাহ পাঁক সে বিষয়ে সম্যক অবগত। (আল কুরআন ২৪/৩০)
এরপর মহান আল্লাহ তা’আলা নারীদের উদ্যেশ্যে রসুলে পাঁক ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামকে নির্দেশ দেন এই বলেঃ “(হে নবী ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) আপনি মুমিনা নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হেফাযত করে, (১) তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে বেড়ায়, (২) তবে তাদের (শরীরের) যে অংশ (এমনিই) খোলা থাকে (সেটার কথা আলাদা), (৩) তারা যেন তাদের ওড়নাগুলোকে তাদের বক্ষদেশের ওপর (এমনভাবে) দিয়ে রাখে (যেনো তা পুরুষদের নজর থেকে লুকিয়ে যায়), (৪) তারা যেন (৫) তাদের স্বামী (৬) তাদের পিতা, তাদের শ্বশুর, তাদের ছেলে, তাদের স্বামীর (আগের ঘরের) ছেলে, তাদের ভাই, তাদের ভাইয়ের ছেলে, তাদের বোনের ছেলে (৭) তাদের (সচরাচর মেলামেশার) মহিলা (৮) নিজেদের অধিকারভুক্ত সেবিকা দাসী (৯) নিজেদের অধীনস্থ (এমন) পুরুষ যাদের (মহিলাদের কাছ থেকে) কোনো কিছুই কামনা করার নেই (১০) কিংবা এমন শিশু যারা এখনো মহিলাদের গোপন অংগ (লজ্জাস্থান) সম্পর্কে কিছুই জানে না-(এসব মানুষ ছাড়া তারা যেন) (১১) অন্য কারো সামনে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে), আর (বাহীরে চলার সময়) তারা যেন নিজদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে।; (১২) হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, (আগের ক্রটি বিচ্যুতির জন্যে) তোমরা সবাই মহান আল্লাহ তা’আলার দরবারে তাওবা করো, আশা করা যায় তোমরা নাজাত পেয়ে যাবে।” (১৩) (আল কুরআন ২৪/৩১)
১) এই দীর্ঘ আয়াত শরীফের শুরুতে সেই বিধানই বর্ণিত হয়েছে, যা পূর্ববর্তী আয়াতে পুরুষদের জন্য ফরজ করা হয়েছে। অর্থাৎ তারা যেন দৃষ্টি নত রাখে তথা দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় নন মাহরামের দিক থেকে। পুরুষদের ঐ বিধানে নারীরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল, কিন্তু আলাধা করে জোর দেয়ার জন্য তাদের কথা পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর) যদিও মহিলারা দৃষ্টি সংযত রাখা ও গুপ্তাঙ্গের হিফাযত করাটা প্রথম আদেশেই শামিল ছিল, যা ব্যাপকভাবে সকল মু’মিনদেরকে দেওয়া হয়েছে; যেহেতু মু’মিন মহিলারাও ব্যাপকার্থে মু’মিনদেরই অন্তর্ভুক্ত। তবুও এখানে বিষয়টির গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য রেখে বিশেষভাবে মহিলাদেরকেও দ্বিতীয়বার সেই একই আদেশ দেওয়া হচ্ছে। যার উদ্দেশ্য হল তাকীদ ও গুরুত্ব আরোপ। এখান হতে কিছু উলামাগণ দলীল গ্রহণ করে বলেছেন যে, যেরূপ পুরুষদের জন্য বেগানা মহিলাদেরকে তাকিয়ে দেখা নিষিদ্ধ, অনুরূপ মহিলাদের জন্যও বেগানা পুরুষদেরকে তাকিয়ে দেখা ব্যাপকভাবে নিষিদ্ধ।
তাছাড়া সকল গ্রহণযোগ্য ইমামদের মতেঃ নারীদের জন্য মাহরাম নয়, এমন পুরুষের প্রতি ইচ্ছাকৃত দর্শন সর্বাবস্থায় হারাম; কামভাব সহকারে বদ নিয়তে দেখুক অথবা সাধারণ অবস্থায়ই দেখুক। (ইবন কাসীর) তারা প্রমাণ হিসেবে উম্মে সালামা আলাইহাস সালাম থেকে বর্ণিত হাদীস উপস্থাপন করেছেন, যাতে বলা হয়েছেঃ একদিন উম্মে-সালামা ও মায়মুনা আলাইহাস সালাম উভয়েই রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলেন। হঠাৎ অন্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রদ্বিয়াল্লাহু আনহু তথায় আগমন করলেন। এই ঘটনার সময়-কাল ছিল পর্দার আয়াত শরীফ নাযিল হওয়ার পর। রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম তাদের উভয়কে পর্দা করতে আদেশ করলেন। উম্মে-সালামা আলাইহাস সালাম বললেনঃ ইয়া রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম, তিনি তো অন্ধ, তিনি আমাদেরকে দেখতে পাবেন না এবং আমাদেরকে চেনেনও না। রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা তো অন্ধ নও, তোমরা তাকে দেখছ। (তিরমিযী শরীফ ২৭৭৮, আবু দাউদ শরীফ ৪১১২, রিয়াদুস স্বলেহীন ১৬২৬, মিশকাত ৩১১৬) এখন আল্লাজির হুকুম নাই বলে উম্মতের মাতাগণকে এই নির্দেশ দেন রসূলে পাঁক ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম, যে গায়রে মাহ্রাম পুরুষদের দিকে তাকানো তোমাদের জন্যে যায়েজ না যদিও সে অন্ধ হয় আর তা সাধারণ দৃষ্টিপাত ও হয়ে থাকে, তাহলে সাধারণ আম পুরুষেরা যখন কামভাব নিয়ে চেহারা উন্মুক্ত মহিলার দিকে তাকাবে তখন এর ভয়াবহতা কেমন হতে পারে? ধরে নিলাম মুসলিম পুরুষ সবাই মুমিন ঈমানদার। বোনেরা চেহারা না ঢাকলেও তাদের দিকে কারো তাকানোর হুকুম আল্লাহ তাআলা দেন নাই। কিন্তু অমুসলিম ও বেদ্বীন কেন আল্লাহ তাআলার হুকুম মেনে আপনার দিকে কামভাব নিয়ে তাকাবেনা? যার অন্তরে মহান আল্লাহ তা’আলার ভয় নাই সে রূপ সৌন্দর্যকে অগ্রাহ্য করবে কার ভয়ে?
২) সৌন্দর্য বলতে এমন পোশাক ও অলংকার বোঝায় যা মহিলারা নিজেদের রূপ-সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করে থাকে। যে সৌন্দর্য একমাত্র স্বামীদের জন্য ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। সুতরাং নারীর পোশাক ও অলংকারের সৌন্দর্য প্রকাশ যদি অন্য পুরুষের সামনে নিষিদ্ধ হয়, তাহলে দেহের কোন অংশ খুলে প্রদর্শন করা ইসলামে কেমন করে অনুমতি থাকতে পারে? এ তো অধিকরূপে হারাম তথা নিষিদ্ধ হবে। অর্থাৎ তারা যেন অবৈধ যৌন উপভোগ থেকে দূরে থাকে এবং নিজের সতর অন্যের সামনে উন্মুক্ত করাও পরিহার করে। (দেখুন-তাবারী, ইবন কাসীর) হাদীসে এসেছে, “মহিলা হলো আওরত তথা গোপণীয় বিষয়” (তিরমিযীঃ ১১৭৩, ইবনে হিব্বানঃ ৫৫৯৯, ইবনে খুযাইমাহঃ ১৬৮৫) পুরুষদের জন্য মেয়েদের সতর তার সারা শরীর। স্বামী ছাড়া অন্য কোন-পুরুষ এমন কি বাপ ও ভাইয়ের সামনেও তা খোলা উচিত নয়। মেয়েদের এমন পাতলা বা চোস্ত পোশাক পরা উচিত নয় যার মধ্য দিয়ে শরীর দেখা যায় বা শরীরের গঠন কাঠামো ভেতর থেকে ফুটে উঠতে থাকে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বৰ্ণনা করেন, তার বোন আসমা বিনতে আবু বকর রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের সামনে আসেন। তখন তিনি পাতলা কাপড় পরে ছিলেন। রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম সংগে সংগেই মুখ ফিরিয়ে নেন এবং বলেনঃ “হে আসমা! কোন মেয়ে যখন বলেগ হয়ে যায় তখন তার এটা ও ওটা ছাড়া শরীরের কোন অংশ দেখা যাওয়া জায়েয নয়।” বর্ণনাকারী বলেনঃ রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম তার হাতের কজি ও চেহারার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। (আবু দাউদঃ ৪১০৪)
৩) ‘যা সাধারণতঃ প্রকাশ থাকে’ বলতে এমন সৌন্দর্য (বাহ্যিক আভরণ) বা দেহের অংশকে বুঝানো হয়েছে যা পর্দা বা গোপন করা অসম্ভব। যেমন কোন জিনিস নিতে বা দিতে গিয়ে হাতের করতল, অথবা কিছু দেখতে গিয়ে চোখ গোপন করা সহজ নয়। অনুরূপভাবে হাতের মেহেন্দী, আঙ্গুলের আংটি, চোখের সুর্মা, কাজল, অথবা পরিহিত সৌন্দর্যময় পোশাককে ঢাকার জন্য যে বোরকা বা চাদর ব্যবহার করা হয়, তাও এক প্রকার সৌন্দর্যের অন্তর্ভুক্ত; যা গোপন করা অসম্ভব। অতএব এই সব আভরণের প্রকাশ প্রয়োজন মত দরকার সময়ে বৈধ যারা তাক্বওয়াশীল পর্দার হাক্বিকত বুঝেন কেবল তাদের জন্যে।
আয়াতে পর্দার বিধানের কয়েকটি ব্যতিক্রম আলোচনা করা হচ্ছে। প্রথম ব্যতিক্রম হচ্ছে (مَا ظَهَرَ مِنْهَا) অর্থাৎ নারীর কোন সাজ-সজ্জার অঙ্গ পুরুষের সামনে প্রকাশ করা বৈধ নয়, অবশ্য সেসব অঙ্গ ব্যতীত, যেগুলো আপনা-আপনি প্রকাশ হয়ে পড়ে অর্থাৎ কাজকর্ম ও চলাফেরার সময় সেসব অঙ্গ স্বভাবতঃ খুলেই যায়। এগুলো ব্যতিক্রমের অন্তর্ভুক্ত। এগুলো প্রকাশ করার মধ্যে কোন গোনাহ নেই। এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমের তাফসীর দু’ধরনের। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেনঃ (مَا ظَهَرَ مِنْهَا) বাক্যে উপরের কাপড়; যেমন বোরকা, লম্বা চাদর ইত্যাদিকে ব্যতিক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এগুলো সাজ-সজ্জার পোশাককে আবৃত রাখার জন্য পরিধান করা হয়। আয়াতের অর্থ এই যে, প্রয়োজনবশতঃ বাইরে যাওয়ার সময় যেসব উপরের কাপড় আবৃত করা সম্ভবপর নয়, সেগুলো ব্যতীত সাজ-সজ্জার কোন বস্তু প্ৰকাশ করা জায়েয নয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমাও বলেনঃ এখানে প্রকাশ্য সৌন্দর্য বলতে চেহারা, চোখের সুরমা, হাতের মেহেদী বা রঙ এবং আংটি। সুতরাং এগুলো সে তার ঘরে যে সমস্ত মানুষ তার কাছে প্রবেশ করার অনুমতি আছে, তাদের সামনে প্ৰকাশ করবে।
কোন কোন মুফাসসির এ আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ নারীর আসল বিধান এই যে, সে তার সাজ-সজ্জার কোন কিছুই প্ৰকাশ করবে না। আয়াতের উদ্দেশ্যও তাই। তবে চলাফেরা ও কাজকর্মে স্বভাবতঃ যেগুলো খুলে যায়, সেগুলো অপারগতার কারণে গোনাহ থেকে মুক্ত। নারী কোন প্রয়োজনে বাইরে বের হলে বোরকা, চাদর ইত্যাদি প্রকাশ হয়ে পড়া সুনির্দিষ্ট। লেন-দেনের প্রয়োজনে কোন সময় মুখমণ্ডল ও হাতের তালুও প্রকাশ হয়ে পড়ে। এটাও ক্ষমার্হ, গোনাহ নয়। পক্ষান্তরে কোন কোন মুফাসসির (إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا) এর অর্থ নিয়েছেনঃ “মানুষ স্বাভাবিকভাবে যা প্রকাশ করে দেয়।” এবং তারপর তারা এর মধ্যে শামিল করে দিয়েছেন মুখ ও হাতকে তাদের সমস্ত সাজসজ্জাসহ। (দেখুন-তাবারী, ইবন কাসীর, ফাতহুল কাদীর)
৪) যাতে মাথা ঘাড়, গলা ও বুকের পর্দা হয়ে যায়। কারণ এ সমস্ত অঙ্গ খুলে রাখার অনুমতি নেই। অর্থাৎ তারা যেন বক্ষদেশে ওড়না ফেলে রাখে। خُمُر শব্দটি خمار এর বহুবচন। অর্থ ঐ কাপড়, যা নারী মাথায় ব্যবহার করে এবং তা দ্বারা গলা ও বক্ষ আবৃত হয়ে যায়। جيوب শব্দটি جيب এর বহুবচন- এর অর্থ জামার কলার। (কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর) জাহেলী যুগে মহিলারা মাথায় এক ধরনের আটসাঁট বাঁধন দিতো। মাথার পেছনে চুলের খোঁপার সাথে এর গিরো বাঁধা থাকতো। সামনের দিকে বুকের একটি অংশ খোলা থাকতো। সেখানে গলা ও বুকের উপরের দিকের অংশটি পরিষ্কার দেখা যেতো। বুকে জামা ছাড়া আর কিছুই থাকতো না। পেছনের দিকে দুটো তিনটি খোঁপা দেখা যেতো। তাই মুসলিম নারীদেরকে আদেশ করা হয়েছে তারা যেন এরূপ না করে (আজকে ওয়েস্টার্ন কালচারের আক্রমণে হুবুহু করছে মুসলিম মেয়েরা); বরং ওড়নার উভয় প্রান্ত পরস্পর উল্টিয়ে রাখে, এতে করে যেন সকল অঙ্গ আবৃত হয়ে পড়ে। (ইবন কাসীর) আয়াত নাযিল হবার পর মুসলিম মহিলাদের মধ্যে ওড়নার প্রচলন করা হয়। মু'মিন মহিলারা কুরআনের এ হুকুমটি শোনার সাথে সাথে যেভাবে একে কার্যকর করে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার প্রশংসা করে বলেনঃ সূরা নূর নাযিল হলে রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে (وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ) বাক্যাংশ শোনার পর তারা নিজের কোমরে বাঁধা কাপড় খুলে নিয়ে আবার অনেকে চাদর তুলে নিয়ে সংগে সংগেই ওড়না বানিয়ে ফেলল এবং তা দিয়ে শরীর ঢেকে ফেললো৷ (বুখারী শরীফ ৪৭৫৯)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, উম্মে সালামা আলাইহাস সালাম বলেন, যখন (وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ) এ আয়াত নাযিল হলো, তখন তাদের মাথা এমনভাবে কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে ফেলল মনে হয় যেন তাদের মাথার উপর কাক রয়েছে। (আবু দাউদঃ ৪১০১) এ সম্পর্কিত অন্য একটি হাদীসে আয়েশা সিদ্দিকা আলাইহাস সালাম আরো বিস্তারিত বর্ণনা করে বলেনঃ মহান আল্লাহ তাআলা প্রথম যুগের মুহাজির মহিলাদের উপর রহমত নাযিল করুন তারা (وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ) নাযিল হওয়ার পরে পাতলা কাপড় পরিত্যাগ করে নিজেদের মোটা কাপড় বাছাই করে তা দিয়ে ওড়না তৈরী করে। (আবু দাউদ শরীফ ৪১০২)
৫) এখানে সেই সৌন্দর্য বা প্রসাধন বেগানা পুরুষদের সামনে প্রকাশ করা বৈধ বলা হচ্ছে, যা ইতিপূর্বে বেগানা পুরুষদের সামনে প্রকাশ করা নিষিদ্ধ বলা হয়েছে। অর্থাৎ, পোশাক, অলংকার ও প্রসাধন ইত্যাদির সৌন্দর্য যা চাদর বা বোরকার নিচে গুপ্ত থাকে। এখানে এ মর্মে ব্যতিক্রমধর্মী বর্ণনা এসেছে যে, অমুক অমুক ব্যক্তির সামনে প্রকাশ করা বৈধ হবে।
৬) এদের মধ্যে সবার শীর্ষে হল স্বামী। সেই জন্য স্বামীকে সবার আগে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ স্ত্রীর সকল শোভা- সৌন্দর্য একমাত্র স্বামীর জন্যই নির্দিষ্ট। আর স্বামীর জন্য স্ত্রীর সারা দেহ (দেখা ও ছোঁয়া) বৈধ। (যেহেতু স্বামী-স্ত্রী একে অপরের লেবাস।) এ ছাড়া মাহরাম (বেগানা; যাদের সঙ্গে চিরতরে বিবাহ হারাম) অথবা ঘরে যাদের আসা-যাওয়া সব সময় হয়ে থাকে এবং নৈকট্য বা আত্মীয়তার কারণে বা অন্য কোন প্রাকৃতিক কারণে নারীর প্রতি তাদের সকাম এমন আকর্ষণ সৃষ্টি হয় না, যার ফলে কোন ফিতনা (বা অঘটন) ঘটার আশঙ্কা থাকে, শরীয়তে সেই সমস্ত লোকদের সামনে এবং বেগানা পুরুষদের সামনে সৌন্দর্য প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে এখানে মামা ও চাচার কথা উল্লেখ হয়নি। অধিকাংশ উলামাগণের নিকট এরাও মাহরামের অন্তর্ভুক্ত। এদের সামনেও সৌন্দর্য প্রদর্শন মহিলার জন্য বৈধ। পক্ষান্তরে কিছু উলামার নিকট এরা মাহরামের অন্তর্ভুক্ত নয়। (ফাতহুল কাদীর)
৭) পিতা বলতে বাপ, দাদা, দাদার বাপ এবং তার ঊর্ধ্বে, নানা ও নানার বাপ এবং তার ঊর্ধ্বের সবাই এর অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপ শ্বশুর বলতে শ্বশুরের বাপ, দাদা এবং তার ঊর্ধ্বে সকলেই শামিল। পুত্র বলতে বেটা, পোতা, পোতার বেটা, নাতী নাতীর বেটা এবং এদের নিম্নের সকলেই শামিল। স্বামীর পুত্র বলতেও তার (অন্য স্ত্রীর গর্ভজাত) বেটা, পোতা এবং তার নিম্নের সকলেই শামিল। ভ্রাতা বলতে সহোদর, বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় তিন প্রকারের ভাইকেই বুঝানো হয়েছে। ভ্রাতুষ্পুত্র বলতে ভাইপো বা ভাতিজা ও তাদের নিম্নের সকল পুরুষকে এবং ভগিনী পুত্র বলতে সহোদর, বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় তিন প্রকার বোনের বেটা (ভাগ্নে) ও তাদের নিম্নের সকল পুরুষকে বুঝানো হয়েছে।
৮) ‘তাদের নারীগণ’ বলতে মুসলিম মহিলাদেরকে বুঝানো হয়েছে, যারা আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করেন এবং কোন মহিলার শোভা-সৌন্দর্য, রূপ-লাবণ্য, দৈহিক আকার-আকৃতি নিজেদের স্বামীর বা অন্য কারো কাছে বর্ণনা করেন না। এ ছাড়া যে কোন কাফের মহিলার সামনে সৌন্দর্য প্রকাশ করা নিষেধ। এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন উমার রদ্বিয়াল্লাহু আনহু, আব্দুল্লাহ বিন আববাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু, মুজাহিদ এবং ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল রহমতুল্লাহি আলাইহিম। কেউ কেউ বলেন, এখানে ‘তাদের নারীগণ’ বলতে বিশেষ ধরনের নারীদেরকে বুঝানো হয়েছে, যারা খিদমত ইত্যাদির জন্য সদা সর্বদা কাছে থাকে, আর তার মধ্যে দাসী-বাঁদীও শামিল। (এদের সামনে সৌন্দর্য প্রকাশ করায় দোষ নেই।)
৯) (مَا ملَكَتْ أِيمَانُهُنَّ) “তাদের ডান হাত যাদের মালিক হয়েছে” বলতে কেউ কেউ শুধু ক্রীতদাসী এবং কেউ কেউ শুধুমাত্র ক্রীতদাস অর্থ নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ উভয়কেই বুঝিয়েছেন। হাদীসেও পরিষ্কার এসেছে যে, ক্রীতদাসদের সামনে পর্দার প্রয়োজন নেই। (আবু দাউদঃ পরিচ্ছদ অধ্যায়) অনুরূপভাবে কেউ কেউ তার ব্যাপক অর্থ নিয়ে বলেছেন, তাতে মু’মিন ও কাফের উভয় প্রকার ক্রীতদাস শামিল। তবে এখন যেহেতু কৃতদাস নেই সেহেতু এর হুকুম প্রয়োগের যায়গাও নেই। কেউ যেনো আবার ঘরের কাজের মানুষ কে এই হুকুমের অন্তর্ভুক্ত মনে না করে বসে। কাজের মানুষ আর কৃতদাস এক জিনিস নয়।
১০) কেউ কেউ এ থেকে নির্বোধ, কেউ হিজড়া, খাসি করা বা ধ্বজভঙ্গ, কেউ অতিবৃদ্ধ অর্থ নিয়েছেন। ইমাম শাওকানী রহমতুল্লাহ বলেন, যাদের মধ্যে কুরআনে বর্ণিত গুণ পাওয়া যাবে, তারা এর পর্যায়ভুক্ত এবং অন্যেরা বহির্ভূত হবে।
১১) এ থেকে এমন সব বালককে বুঝানো হয়েছে যারা সাবালক বা সাবালকত্বের নিকটবর্তী নয়। কারণ এরা মেয়েদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অভিজ্ঞ নয়। এইখানে বয়স কোন বিষয় নয়, মূল বিষয় জ্ঞান, কোন ছেলে ৫ বছর বয়সে যদি এইসব জ্ঞান লাভ করে তাহলে সে সাবালকের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত, আর যদি ১০/১২ বছরেও কিছু না বুঝে তাহলে সে সাবালকের অন্তর্ভুক্ত হবেনা।
১২) গোপন আভরণ বা অলঙ্কার প্রকাশ পেয়ে অর্থাৎ, পায়ের নূপুরের শব্দে পুরুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট না হয়। হাই-হিল বা এমন শক্ত জুতা-চপ্পলও এই নির্দেশের শামিল। যেহেতু মহিলারা যখন এসব পরিধান করে চলা-ফিরা করে, তখন তাতে এক ধরনের এমন শব্দ সৃষ্টি হয়, যা আকর্ষণে নূপুরের শব্দের তুলনায় কম নয়। অনুরূপ হাদীসে এসেছে যে, সুগন্ধি মেখে ঘর থেকে বের হওয়া মহিলার জন্য বৈধ নয়। যে এ রকম করে, সে ব্যভিচারিণী। (তিরমিযি শরীফ ২৭৮৬) ফিকিরের বিষয় হলো, হাটার সময় পায়ে যদি বুরকার নিচেও নূপুর থাকে যা শব্দ সৃষ্টি করে তা হারাম নিষিদ্ধা বলেন মহান আল্লাহ পাঁক, তাহলে চেহারা কীভাবে বোনেরা খোলা রাখে? সৌন্দর্য যেন প্রকাশ না হয় একারণে সজোরে পদচারণা নিষেধ, আর চেহারা খোলার অনুমতি দিয়েছেন? চেহারার চেয়ে নূপুরের শব্দ বেশি আকর্ষণীয়? যে সুগন্ধি দেখাই যায়না, সেটা কি চেহারারর চেয়েও বেশি আকর্ষণীয়?
এখানে মূল উদ্দেশ্য নিজেদের অঙ্গ-প্রত্যাঙ্গাদি ও সেগুলোর সৌন্দর্য প্রকাশ হয়ে পড়ার যাবতীয় বস্তুই নিষেধ করা। অনুরূপভাবে দৃষ্টি ছাড়া অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলোকে উত্তেজিতকারী জিনিসগুলোও মহান আল্লাহ তা'আলা মহিলাদেরকে যে উদ্দেশ্যে সাজসজ্জা ও সৌন্দর্যের প্রকাশনী করতে নিষেধ করেছেন তার বিরোধী। তাই রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদেরকে খোশবু লাগিয়ে বাইরে বের না হবার হুকুম দিয়েছেন, কারনঃ “যে মেয়ে মসজিদে খোশবু মেখে আসে তার ছ্বলাত ততক্ষণ কবুল হয় না যতক্ষণ না সে বাড়ি ফিরে ফরয গোসলের মত গোসল করে।” (আবু দাউদঃ ৪১৭৪, ইবনে মাজাহঃ ৪০০২) আবু মূসা আশআরী বলেন, নবী ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “যে নারী আতর মেখে পথ দিয়ে যায়, যাতে লোকেরা তার সুবাসে বিমোহিত হয়, সে এমন ও এমন। তিনি তার জন্য খুবই কঠিন শব্দ ব্যবহার করেছেন। বলেছেন সে ব্যভিচারিণী” (আবু দাউদ শরীফ ৪১৭৩, তিরমিযি শরীফ ২৭৮৬)
১৩) এখানে পর্দার আদেশের পরপর তওবার আদেশ দেওয়ার মধ্যে যুক্তি হল যে, অজ্ঞতার যুগে এই সমস্ত আদেশের যে বিরোধিতা তোমরা করতে তা যেহেতু ইসলাম আসার পূর্বের কথা, সেহেতু তোমরা যদি সত্য অন্তরে তওবা করে নাও এবং উক্ত আদেশের সঠিক বাস্তবায়ন কর, তাহলে সফলতা, ইহ ও পরকালের সৌভাগ্য একমাত্র তোমাদের। অর্থাৎ মুমিনগণ, তোমরা সবাই মহান আল্লাহ তা’আলার কাছে তাওবাহ কর। (কুরতুবী) হাদীস শরীফে এসেছে, তাওবাহ হলো, অনুতপ্ত হওয়া, অনুশোচনা করা, (ইবনে মাজাহ ৪২৫২) এ বিধানগুলো নাযিল হবার পর কুরআনের মর্মবাণী অনুযায়ী নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম ইসলামী সমাজে অন্য যেসব সংস্কারমূলক বিধানের প্রচলন করেন তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হচ্ছেঃ
একঃ মাহরাম আত্মীয়ের অনুপস্থিতিতে অন্য লোকেরা (আত্মীয় হলেও) কোন মেয়ের সাথে একাকী সাক্ষাত করতে ও তার কাছে নির্জনে বসতে পারে না। নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “যেসব নারীর স্বামী বাইরে গেছে তাদের কাছে যেয়ো না। কারণ শয়তান তোমাদের মধ্য থেকে প্রত্যেকের রক্ত ধারায় আবর্তন করছে।” (তিরমিযী শরীফ ১১৭২) রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের দিনের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন কখনো কোন মেয়ের সাথে নির্জনে সাক্ষাৎ না করে যতক্ষণ না ঐ মেয়ের কোন মাহরাম তার সাথে থাকে। কারণ সে সময় তৃতীয়জন থাকে শয়তান।” (মুসনাদে আহমাদ ১১৪)
দুইঃ কোন পুরুষের হাত কোন গায়ের মাহরাম মেয়ের গায়ে লাগুক এটাও রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বৈধ করেননি। তাই তিনি পুরুষদের হাতে হাত রেখে বাই’আত করতেন। কিন্তু মেয়েদের বাই’আত নেবার সময় কখনো এ পদ্ধতি অবলম্বন করতেন না। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, “নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের হাত কখনো কোন ভিন মেয়ের শরীরে লাগেনি। তিনি মেয়েদের থেকে শুধুমাত্র মৌখিক শপথ নিতেন এবং শপথ নেয়া শেষ হলে বলতেন, যাও তোমাদের বাই’আত হয়ে গেছে।” (বুখারী শরীফ ৫২৮৮, মুসলিম ১৮৬৬)
তিনঃ মেয়েদের মাহরাম ছাড়া একাকী অথবা গায়ের মাহরামের সাথে সফর করতে রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম কঠোরভাবে নিষেধ করতেন। রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “কোন পুরুষ যেন মহিলার সাথে একান্তে সাক্ষাৎ না করে যতক্ষণ তার সাথে তার মাহরাম না থাকে এবং কোন মহিলা যেন সফর না করে যতক্ষণ না তার কোন মাহরাম তার সাথে থাকে।” (বুখারী শরীফ ১৮৬২, ৩০০৬, ৩০৬১, ৫২৩৩, মুসলিম শরীফ ১৩৪১)
মুদ্দাকথা ইসলামীক পরিবার গঠনে মাহরাম-গায়ের মাহরামের জ্ঞান থাকাটা অত্যাবশ্যকীয় ফরজ কাজ। উপরের ছবিটির মাধ্যমে বোনেরা তাদের নিকট আত্নীয়দের মধ্যে কে মাহরাম আর কে গায়ের মাহরাম তা বুঝতে পারবেন। সবুজ রঙের মাধ্যমে মাহরাম ও লাল রঙের মাধ্যমে গায়ের মাহরাম বোঝানো হয়েছে।
যারা মাহরাম নন, তাদের সাথে দেখা, সাক্ষাৎ করা নিষিদ্ধ, কারণ মহান আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তোমরা যখন উম্মাহাতুল মু’মিনিনদের নিকট কোন কিছু চাও, তখন পর্দার আড়াল থেকেই তাদের নিকট চাও। এটাই তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য পবিত্রতর। (আল কুরআন ৩৩/৫৩) যদিও এই আয়াত শরীফ উম্মাহাতুল মু’মিনিন আলাইহিন্নাস সালাম উনাদের উদ্যেশ্যে নাযিল হয়েছিলো, কিন্তু এ আয়াতে বর্ণিত পর্দার হুকুমটি প্রতিটি ঈমানদার নারী ও পুরুষের পর্দার হুকুমের অন্তর্ভুক্ত। (আদওয়াউল-বায়ান; কুরতুবী) আরেকটি বিষয় হলো, বাজারি মহিলাদের সম্মুখেও মুমিনা নারীরা পর্দা করা লাগবে, নতুবা সমূহ বিপদের সম্ভবনা আছে, এইসব মহিলা সুন্দরী, সম্ভ্রান্ত মেয়েদের চেহারার বর্ণনা বখাটেদের দিয়ে থাকে, এর দ্বারাও সেই মুমিনা বেপর্দা হয়ে থাকে। শুধু বেপর্দাই না, অনেক সময় এইসব বখাটেরা সেইসব মেয়েদের বর্ণনা শোনে বিয়ের প্রস্থাব দেয়, তখন দেখা যায় তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, ফলে অনেকেই সেই মুমিনার ইজ্জতের উপর আঘান হেনে বসে।
এছাড়াও বিনা প্রয়োজনে কথা বলাও নিষিদ্ধ, প্রয়োজনে বল্লেও তা কর্কশ করার হুকুম দিয়েছেন মহান আল্লাহ তা”আলাঃ যদি তোমরা (সত্যিই) মহান আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করে থাকো, তাহলে পর পুরুষের সাথে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, (যদি এমন করো) তাহলে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে সে তোমার ব্যপারে প্রলুদ্ধ হয়ে পড়বে। (১) আর তোমরা (সর্বদাই) ভালোভাবে কথা বলবে। (২) (আল কুরআন ৩৩/৩২)
১) মহান আল্লাহ তাআলা যেরূপভাবে নারী জাতির দেহ-বৈচিত্রে পুরুষের জন্য যৌন আকর্ষণ সৃষ্টি করেছেন (যা থেকে হেফাযতের বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ডেকে রেখে, যাতে নারী পুরুষের জন্য ফেতনার কারণ না হয়ে পড়ে।) অনুরূপভাবে তিনি নারীদের কণ্ঠস্বরেও প্রকৃতিগতভাবে মন কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা, কোমলতা ও মধুরতা রেখেছেন, যা পুরুষকে নিজের দিকে আকর্ষণ করতে থাকে। সুতরাং সেই কণ্ঠস্বর ব্যবহার করার ব্যাপারেও এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, পরপুরুষের সাথে বাক্যালাপের সময় ইচ্ছাপূর্বক এমন কণ্ঠ ব্যবহার করবে, যাতে কোমলতা ও মধুরতার পরিবর্তে সামান্য শক্ত ও কঠোরতা থাকে। যাতে ব্যাধিগ্রস্ত অন্তরবিশিষ্ট লোক কণ্ঠের কোমলতার কারণে তোমাদের দিকে আকৃষ্ট না হয়ে পড়ে এবং তাদের মনে কুবাসনার সঞ্চার না হয়।
২) অর্থাৎ, এই কর্কশতা ও কঠোরতা শুধু কণ্ঠস্বরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, অর্থাৎ মুখে এমন কটু বাক্য আনবে না, যা অসঙ্গত ও সচ্চরিত্রতার পরিপন্থী। (إِنِ اتَّقَيْتُنَّ) যদি তোমরা মহান আল্লাহ তাআলাকে ভয় কর বলে, আল্লাহ তাআলা ইঙ্গিত করেছেন যে, এই কথা এবং অন্যান্য নির্দেশাবলী যা সামনে বর্ণনা করা হবে, তা মুত্তাক্বী নারীদের জন্য (যারা মহান আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে)। কারণ তাদেরই আশঙ্কা থাকে যে, যাতে তাদের আখেরাত বরবাদ না হয়ে যায়। পক্ষান্তরে যাদের হৃদয় মহান আল্লাহ তাআলার ভয়শূন্য তাদের সাথে এই নির্দেশাবলীর কোন সম্পর্ক নেই। তারা কখনোও এর পরোয়া করবে না মহান আল্লাহ তাআলা কি নির্দেশ দিলেন বা না দিলেন।
তাছাড়া নারীরা প্রয়োজন ছাড়া নিজেদের আওয়াজ পুরুষদেরকে শোনাবে এটাও রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম অপছন্দ করতেন। প্রয়োজনে কথা বলার অনুমতি কুরআনে যদিও দেয়া হয়েছে এবং নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের পবিত্ৰ আহলিয়াগন নিজেরাই লোকদেরকে দ্বীনী মাসায়েল বর্ণনা করতেন, কিন্তু যেখানে এর কোন প্রয়োজন নেই এবং কোন দ্বীনী বা নৈতিক লাভও নেই সেখানে মহিলারা নিজেদের আওয়াজ ভিন্ন পুরুষদেরকে শুনাবে এটা পছন্দ করা হয়নি। একারণেই রসূলে পাঁক ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের যামানায় নারীদের মসজিদে জামাআতে যাওয়ার যখন হুকুম ছিলো তখন ছ্বলাতে যদি ইমাম কোন কিছু ভুলে যান তখন পুরুষদেরকে সুবহানাল্লাহ বলার হুকুম দেয়া হলেও মেয়েদেরকে এক হাতের উপর অন্য হাত মেরে ইমামকে সতর্ক করে দেবার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। (বুখারী শরীফ ১২০৩, মুসলিম শরীফ ৪২১, ৪২২)
মূলত যাহিলদের বুঝাতে কিতাব এর পর কিতাবের ব্যাখ্যা লিখা লাগে, জ্ঞানীদের জন্য ইশারাই কাফি। খেয়াল করুন, রসূলে পাঁক ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি অহংকার বশে (পায়ের গোড়ালীর নীচে) কাপড় ঝুলিয়ে চলবে আল্লাহ পাক কিয়ামত দিবসে তার প্রতি রহমতের দৃষ্টিপাত করবেন না”। (বুখারি শরীফ ও মুসলিম শরীফ) অথচ উম্মুল মু’মিনীন উম্মে সালামা আলাইহাস সালাম জিজ্ঞাসা করলেন, নারীগণ চাদরের নিম্নাংশ কতটুকু পরিমাণ ঝুলিয়ে রাখবে? রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, অর্ধহাত পরিমাণ। উম্মুল মু’মিনীন উম্মে সালামা আলাইহাস সালাম আবারও প্রশ্ন করলেন এ অবস্থায় মহিলার পা দৃষ্টিগোচর হবে। তদুত্তরে রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বললেন- তাহলে একহাত পরিমাণ ঝুলিয়ে রাখবে এর অধিক নয়। (মিশকাত শরীফ ৪৩৩৪) এ হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত হল যে, যেখানের পুরুষদের ঘণ্টার নিচে পোশাক গেলে আল্লাহ পাঁকের রহমতের দৃষ্টি থেকে মাহরুম হবে, সেখানে মহিলাদের পা আবৃত রাখা ওয়াজিব করা হয়েছে, যা উম্মুল মু’মিনীন উম্মে সালামা আলাইহাস সালাম এবং মহিলা ছাহাবায়ে কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাগন উনাদের অজানা ছিল না। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, মহিলার পা দর্শনে যতটুকু ফিৎনার আশংকা রয়েছে তার চাইতে হাত ও মুখমন্ডল দর্শনে ফিৎনার আশংকা বেশি। অতএব পা দর্শন যা ফিৎনার নগণ্যতম মাধ্যম তাতে সতর্কবাণীর ফলে হাত ও মুখমন্ডল দর্শন যা সন্দেহাতীতভাবে অধিকতর ফিৎনাস্থল তার বিধান স্পষ্ট হয়ে গেল। আপনারা ভালোভাবে অবগত আছেন যে, প্রজ্ঞাভিত্তিক সুসম্পূর্ণ নিখুত শরিয়তে মহিলার পা যা ফিৎনার নগণ্যতম পন্থা তাতে পর্দার নির্দেশ দিয়ে হাত ও মুখমন্ডল যা ফিৎনার মূল উৎস তা উম্মুক্ত রাখার অনুমতি প্রদান করবে, তা কস্মিণকালেও হতে পারে না। অতএব প্রমানিত হলো মহিলাদের মুখমন্ডল, হাত,পা সবঅঙ্গই পর্দার অন্তর্ভূক্ত। মহান আল্লাহ তা’আলা আমাদের মা বোনদের পর্দার হুকুম মানার ও পালন করার তৌফিক দিন এই কামনাই করি।
0 ফেইসবুক: