Tuesday, October 9, 2018

৬৫’র যুদ্ধে ব্যর্থতার পর আইয়ূব খানের পুনর্জীবন লাভ, ছয় দফার হাক্বীক্বত ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি (২)

(পূর্ব প্রকাশিতের পর) ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্রবলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একটি উপাধি রয়েছে। এই উপাধি তিনি অর্জন করেছিলেন আইয়ূবের সেনাশাসনের বিরুদ্ধে সমস্ত রাজনৈতিক দলকে একত্রিত করে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট বা এনডিএফগঠনের মাধ্যমে। পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সোহরাওয়ার্দীর সর্বদলীয় গ্রহণযোগ্যতায় শঙ্কিত হয়ে আইয়ূব সরকার তাকে কারারুদ্ধ করেছিল। কারাগারে থাকাকালীন সোহরাওয়ার্দীর হৃদরোগ দেখা দেয়। ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দী এজন্য হৃদরোগের চিকিৎসা নিতে লন্ডন গমন করেন।

শেখ মুজিব শুরুতে ফ্রন্টের কার্যক্রমে খুব উৎসাহী ছিলেন, কিন্তু কিছুদিন না যেতেই তিনি ফ্রন্টের আরেকজন শরিক ভাসানীর অনুকরণে ফ্রন্টের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করতে লাগলেন। লন্ডনে সোহরাওয়ার্দীর হৃদরোগের চিকিৎসার সময়েও তিনি সেখানে গিয়েছিলেন ফ্রন্ট ভেঙে আওয়ামী লীগ নিয়ে বের হয়ে আসার প্রস্তাব নিয়ে। আতাউর রহমান খান এ প্রসঙ্গে স্বৈরাচারের দশ বছরগ্রন্থের ২৬৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেনঃ শেখ মুজিব খুব পীড়াপীড়ি করেছিলেন। কিন্তু নেতা স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে, যদি পার্টি রিভাইভ করা হয়, তা হলে আমি পাকিস্তানে ফিরে যাব না। আমি কাউকে মুখ দেখাতে পারব না। দেশে ফিরে গিয়ে এনডিএফ এর কাজ কর।

কিন্তু লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পথে বৈরুতে হোটেলকক্ষে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু হয়, আর এই সুযোগেই শেখ মুজিব ফের অস্থির হয়ে উঠলেন পার্টি রিভাইভের জন্য। ওদিকে আবুল মনসুর আহমদ তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, পার্টি রিভাইভ করতে এনডিএফের আরেকজন শরিক ভাসানীর ন্যাপও মুখিয়ে আছে, সুতরাং আগেভাগে পার্টি রিভাইভ করে এনডিএফ ভাঙার দায় যেন আওয়ামী লীগ একা না নেয়। কিন্তু শেখ মুজিবের তর সইছিল না, নিষেধ সত্ত্বেও তিনি আগেভাগে আওয়ামী লীগ দলটিকে পুনরুজ্জীবিত করলেন। এ প্রসঙ্গে আতাউর রহমান খান তার বইয়ের ২৯৬-২৯৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেনঃ সরকারী মহল খুশীতে বাগবাগ। কনভেনশন লীগের (আইয়ূব খানের সরকারী দল) প্রেসিডেন্ট জবর খাঁ  জবর খুশী হলেন। তিনি ও তার সেক্রেটারী হাশিম উদ্দিন অভিনন্দন জানালেন। মর্নিং নিউজ’ (সরকারপন্থী পত্রিকা) শেখ মুজিবের ছবি ছাপাল।

আয়ুব খাঁরও খুশী হবার কথা। তিনি প্রাণপণে এটা চেয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে সবাই মিলে যে সংগ্রামের হুমকি দিয়েছিল, সেটা বাদ দিয়ে নিজেদের মধ্যে ঘরোয়া সংগ্রামের যে সূত্রপাত করা হল, এতে নিশ্চয় তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

এর পর যথারীতি ন্যাপও রিভাইভড হয়ে গেল। কথা ছিল এক সঙ্গে হবার। যাতে কেউ কারও উপর দোষ চাপাতে না পারে। কিন্তু ন্যাপ টেক্কা মারল। চালাকী করে পিছে রইল। দোষটা ষোলআনা চাপল আওয়ামী লীগের ঘাড়ে।

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবকে সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী হিসেবে তুলে ধরে গর্ববোধ করে থাকে। কিন্তু তৎকালীন ইতিহাসের নিরিখে আমরা দেখতে পাই যে, সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পূর্বে দেয়া নির্দেশও শেখ মুজিব ভঙ্গ করেছিলেন, যার ফলে অবধারিতভাবে লাভবান হয়েছিলেন সেনাশাসক আইয়ূব খান।

আরেকটি ঘটনা আতাউর রহমান খান উল্লেখ করেছেন ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময়কার। সে সময়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী ছিলেন শেখ মুজিব। আইয়ূব খানের গদি তখন টলটলায়মান। এ অবস্থায় পরিস্থিতি সামলাতে রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বৈঠকে বসতে চাইলেন তিনি। বন্দী শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে আইয়ূব খানের বৈঠকে নেয়া হবে, এমন অপমানজনক সিদ্ধান্ত হলো। শেখ মুজিব তাতে সম্মতি জ্ঞাপন করলেন, তাকে উৎসাহ দিলেন ইত্তেফাকের সম্পাদক মানিক মিয়া।

কিন্তু অন্যান্য বন্দীরা তার তীব্র প্রতিবাদ জানালেন, বললেন মামলা প্রত্যাহার না হলে কিছুতেই আইয়ূবের সাথে এক টেবিলে বসা যাবে না। শেষ পর্যন্ত সঙ্গী বন্দিদের চাপের মুখে শেখ মুজিব প্যারোলে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। পরিশেষে আইয়ূব খান মামলা প্রত্যাহার করলে শেখ মুজিব তার সাথে মিটিংয়ে যোগদান করেন।

এখানে প্রশ্ন হতেই পারে, শেখ মুজিব কেন প্যারোলে আইয়ূব খানের সাথে মিটিং করার অসম্মানজনক প্রস্তাবে শুরুতে রাজী হয়েছিলেন? উত্তরটি দেয়া কঠিন কিছু নয়।

পরিশেষে বলতে হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। ছয় দফা প্রণয়নের পর আইয়ূববিরোধী সম্মেলন যখন ভেঙে গেল, তারপর আইয়ূব খান একে কেন্দ্র করে উস্কানীমূলক বক্তব্য দিতে লাগল ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য। এ প্রসঙ্গে আতাউর রহমান খান বইয়ের ৩৫৮-৩৫৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেনঃ যুদ্ধের পর আয়ুব খাঁ লাহোরে কোনো জনসভা করতে সাহস করেন নাই। যুদ্ধের গ্লানি, অপরিসীম ধ্বংস ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিশ্চয়ই তাকে অভিভূত করার কথা। যুদ্ধক্ষেত্রে সুবিধা করতে না পেরে রাজনীতি ক্ষেত্রে নামলেন। শত্রুর সাথে আপোষ নিষ্পত্তি সম্পন্ন করে দেশবাসীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করলেন।

প্রথমঃ ছয় দফা। এর বিরুদ্ধে বক্তৃতা করলেন। ছয় দফা পাকিস্তানের ধ্বংসকামী। এর উদ্দেশ্য পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক ও স্বাধীন করা।

দুই নম্বরঃ পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ বা সিভিল ওয়ারের আশঙ্কা। কার সাথে, কোথায়, কবে তা কিছু বললেন না। তিনিই বা কোথা থেকে এ গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য আবিষ্কার করেছেন তাও জানা গেল না। উত্তরে আমরাও বললাম,যদি গৃহযুদ্ধ বেঁধেই যায় তা হলে তার দায়িত্বও ষোল আনা আপনাকে নিতে হবে। অন্য কেউ এর বিন্দু বিসর্গও জানে না।

সম্বিৎ ফিরে পাবার পর এ বিষয়ে আর বেশী বাড়াবাড়ি করেন নাই। ভাবলেন, কথাটা বড় বেমৌকা হয়ে গেছে। গুলি ফসকে গেছে।

তিন নম্বরঃ জাতীয় সংহতি-ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন। কোথায় অসংহতি? তবুও সংহতি সংহতি বলে চীৎকার উঠেছে কায়েমী স্বার্থবাদী মহলে। আসল সমস্যা সমাধান না করার এ সব বাহানা।

এই সব বিভ্রান্ত-প্রচারণা কিছুদিনের জন্য দেশের প্রভূত ক্ষতি সাধন করে। মানুষের ভেতর অনাস্থা, অবিশ্বাস সৃষ্টি করা হয়। ভবিষ্যৎ মঙ্গল সম্বন্ধে সকলেই সন্দিহান হয়ে পড়ে। বিশ্বাসের গোড়া একবার নড়ে উঠলে, আর তাকে শক্ত করা যায় না।

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! আইয়ূব খান যতগুলো বক্তব্য দিয়েছিল, তথা পূর্ব পাকিস্তানের পৃথকীকরণ, গৃহযুদ্ধ এবং জাতীয় অসংহতি, প্রত্যেকটিই একাত্তরে তীব্র সত্য হয়ে দেখা দিল। আতাউর রহমান খান বইটি প্রকাশ করেছিলেন ১৯৭০ সালে, মুক্তিযুদ্ধ তখনও হয়নি। তিনি তাই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে কোথায় গৃহযুদ্ধ! কোথায় অসংহতি! মূলত পাকিস্তানী সেনাশাসকেরা যেই ছক সাজিয়েছিল ক্ষমতা ধরে রাখতে, তা তারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল। আইয়ূব খান হয়তো ভেবেছিল, ছয় দফা দিয়ে তার বিরোধীদলের জমায়েত বানচাল করা হবে, আবার এই ছয় দফাকে উছিলা করে গৃহযুদ্ধ ও অসংহতির হুজুগ তুলে পূর্ব পাকিস্তানকে শত্রু দেখিয়ে বিক্ষুব্ধ পশ্চিম পাকিস্তানকে ঠাণ্ডা করাও সম্ভবপর হবে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে শত্রু বানাতে গিয়ে পরিশেষে পাকিস্তানই ভেঙে গেল। ধূর্ত রাজনীতিবিদ ও স্বৈরাচারী শাসকদের পর্দার আড়ালের কূটকৌশলের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ মুসলমান শহীদ হলো।

আসলে এই যে তন্ত্র-মন্ত্রের জাল, তথা গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্র ইত্যাদি, এসবের সাজানো ছকেই মুসলমানরা ঘুরপাক খাচ্ছে, ব্যবহৃত হচ্ছে, হত্যা ও সম্ভ্রমহানির শিকার হচ্ছে। আতাউর রহমান খান তার বইতে লিখেছেন, যখন আইয়ূব খান ভারতের সাথে অস্ত্রবিরতি চুক্তি করলেন, তখন লাহোরে পাকিস্তানী সেনাদের বিধবা স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা মিছিল করেছিল এই বলে যে, তাদের স্বামীরা শাহাদাতের সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে নাই। অকারণে তাদের মূলবান জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। অর্থাৎ স্বামী-সন্তান হারানোর পর তাদের বোধ হয়েছিল যে, তারা বৃথা মরীচিকার পেছনে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছে, পুরোটাই ছিল রাজনীতিবিদদের নিজস্ব স্বার্থের খেলা মাত্র।

এই বোধ সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মাঝেই জাগ্রত হতে হবে। বর্তমানে তারা সকলেই ফাঁকা অন্তঃসারশূন্য বস্তুর জন্য লড়ছে, অর্থ ও জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। হোক সে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, ছয় দফা কিংবা সাতচল্লিশের পাকিস্তান আন্দোলন, প্রচলিত ইতিহাসের বয়ান কর্তৃক বিরাট মহিমা প্রদানের আড়ালে বাস্তবে সবই অন্তঃসারশূন্য। কারণ এগুলোর জন্ম হয়েছে রাজনীতি তথা তন্ত্রমন্ত্রের মাধ্যমে, আর তন্ত্রমন্ত্র থেকে উদ্ভূত সংগ্রাম, যুদ্ধ বা রাজনৈতিক আন্দোলন সবই পর্দার আড়ালের খেল মাত্র। এসব থেকে মুসলমানদের লাভ করার কিছুই নেই। একমাত্র খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবুওয়াত থেকেই মুসলমান তার অভীষ্ট লক্ষ্য, দুনিয়া ও আখিরাত উভয়েরই, আদায় করে নিতে পারে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুনঃ

এডমিন

আমার লিখা এবং প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা সম্পূর্ণ বে আইনি।

0 ফেইসবুক: