Saturday, December 15, 2018

সম্রাজ্যবাদীদের প্রক্সিওয়ারে ব্যবহৃত জনগণ, ‘জনগণের পক্ষ’ তৈরী হবে কবে?

প্রক্সিওয়্যার শব্দটার সাথে জনগণ পরিচিত নয়। যদিও জনগণ প্রতিনিয়ত পরিচালিত হচ্ছে প্রক্সিওয়্যারের মাধ্যমেই। প্রক্সিশব্দের শাব্দিক অর্থ অন্যের পরবর্তিরূপে কাজ করাবা বদলি কাজ’, ওয়্যার শব্দের অর্থ যুদ্ধ। ছোট বেলায় ক্লাসে উপস্থিত না হয়ে বন্ধুদের বলতাম, ‘দোস্ত আমার হয়ে প্রক্সি দিয়ে দিস। মানে আমি উপস্থিত থাকবো না, তুই আমার হয়ে হাজিরা দিয়ে দিস। আন্তর্জাতিক সম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো প্রতিনিয়ত নিজের স্বার্থ নিয়ে কামড়াকাড়িতে ব্যস্ত। সারা বিশ্বজুড়ে চলে তাদের এই যুদ্ধ। কিন্তু সাধারণভাবে সেটা দেখা যায় না, কারণ তারা নিজেরা কখন মাঠে নেমে যুদ্ধ করে না, তারা ভিন্ন একটি দেশকে ব্যাটলফিল্ড বা যুদ্ধক্ষেত্রে বানিয়ে সে দেশের জনগণ দিয়ে সেই যুদ্ধের প্রক্সি দেয়। কিন্তু এরমধ্যে চাতুরতা এত বেশি থাকে যে, সাধারণ মানুষ সেটা ধরতে পারে না। সে ভাবে, সে নিজের জন্য যুদ্ধ করছে, কিন্তু বাস্তবে সে সম্রাজ্যবাদীদেশগুলো স্বার্থের জন্য প্রক্সিওয়্যারে ব্যবহৃত হচ্ছে।

৪৭ এ বহু কাঠখড় পুড়িয়ে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর, সেটা ভাঙ্গার প্রথম পরিকল্পনা ছিলো আমেরিকার। সেই প্রথম ঘি ঢালে জাতীয়বাদ থিউরী ছড়িয়ে। পাকিস্তানী শাসকদের মাথামোটা বক্তব্যে আমেরিকার থিউরী সফল হয়, সৃষ্টি হয় ৫২র ভাষা আন্দোলন।  ৬৬-৬৯ পাকিস্তান ভাগ করার পর্যায়গুলো মোটামুটি আমেরিকার নিয়ন্ত্রণেই থাকে, কিন্তু বিপত্তি ঘটে ৭০ এর নির্বাচনে এসে।  আমেরিকার বদলে পাকিস্তান ভাগ করার আন্দোলন নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে চেষ্টা করে রাশিয়া। পাকিস্তানী শাসকদের মাথামোটা সিদ্ধান্তের দরুণ ২৫ মার্চের নির্মম গণহত্যা এবং শেখ মুজিবকে গ্রেফতার যদি না করা হতো, তবে আদৌ বাংলাদেশ নামক কোন দেশ জন্ম নিতো কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। শেখ মুজিব চেয়েছিলেন কনফেডারেশনটাইপের পূর্ব পাকিস্তান, কিন্তু শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে চালকের আসনে বসে পড়ে পাক্কা রাশিয়ান এজেন্ট তাজউদ্দিন আহমেদ। আরেক রাশিয়ান ব্লকের সদস্য ভারতীয় কংগ্রেসের ইন্দিরা গান্ধী তখন ক্ষমতায়, মিলে যায় ক্ষাপে ক্ষাপ। আমেরিকার এতদিনের সখের সূচ রাজার চোখের সূচসরানোর উদ্যোগ নিয়ে নেয় রাশিয়া। স্বাধীন হয়ে যায় বাংলাদেশ। রাশিয়ান ব্লকের নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে, আমেরিকা তো বসে থাকার পাত্র নয়। তাদের এজেন্ট জাসদসহ নাস্তিকগুলো দিয়ে দেশে তৈরী করতে থাকে বিশৃঙ্খলা। ভাত দে, নয় মানচিত্র খাবো”, শ্লোগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের সেন্টিমেন্টকে ঘুড়িয়ে এন্টি আওয়ামীলীগবিরোধী সেন্টিমেন্ট উস্কাতে থাকে। সিরাজ শিকদার হত্যা কিংবা বাকশাল প্রতিষ্ঠা সবাই ছিলো আমেরিকার বিরুদ্ধে রুশ প্ল্যানের অংশ। মার্কিনীদের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবর একের পর এক একশনে ক্ষেপতে থাকে আমেরিকা। শেখ মুজিবরও মার্কিন বিরোধী প্ল্যান নিজ দেশ ছেড়ে বাইরে বর্ধিত হতে থাকে। পূর্বের বন্ধু ভুট্টোর সাথে ফের খাতির করে নতুন নতুন প্ল্যান নিতে থাকে শেখ মুজিব। ক্ষেপে যায় সিআইএ। বাংলাদেশে কথিত সেনা অভ্যুথানের নাম দিয়ে হত্যা করে শেখ মুজিবকে, পাকিস্তানে ভুট্টোকে। শেখ মুজিব হত্যার পর সিআইএপন্থীরা ট্যাঙ্কে চড়ে উল্লাস করে। এরপর বাংলাদেশে সিআইএপন্থী ও রুশপন্থী সেনাসদস্যের মধ্যে ক্যু-পাল্টা ক্যু চলতে থাকে। টানা ৮ বছর চলে সেনাসদস্যদের মধ্যে সেই আত্মঘাতি প্রক্সিওয়্যার। হাজার হাজার সেনাসদস্য মারা যায়, যার মধ্যে অধিকাংশ মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন। ৮৩ সালে এসে ক্ষমতা নিয়ে নেয় সুযোগ সন্ধানী এরশাদ। এরশাদ ব্যক্তিগতভাবে চালাক ছিলো। সে নিজের জন্য অনেক কিছু-ই করতো, কিন্তু সম্রাজ্যবাদীদের কথা ডাইরেক্ট শুনতো না।  এতে ক্ষেপে যায় সম্রাজ্যবাদীরা। মিডিয়ার মাধ্যমে স্বৈরশাসকট্যাগ লাগিয়ে মার্কিনপন্থী, চীনপন্থী আর রুশপন্থী সব এক হয়ে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, ক্ষমতা থেকে নামাতে চায়। ১৯৯০ সালে ক্ষমতা থেকে নেমে যায় এরশাদ। ১৯৯১ সালে ফের মার্কিন-চীন ব্লকের (তখন মার্কিন-চীন জোট ছিলো) দল ক্ষমতায় চলে আসে। ইতিমধ্যে শেখ হাসিনাকে রুশব্লকের কংগ্রেস ট্র্রেনিং দিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে তার ১০ বছর হয়ে গেছে, যদিও আওয়ামীলীগ ঠিক তখনও গুছিয়ে উঠতে পারেনি। তবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরে আসায় আওয়ামীলীগের আসার সম্ভবনা তৈরী হয়। তাছাড়া সম্রাজ্যবাদীরাও চায় গণতন্ত্র দিয়ে দেশ চলুক, কারণ সেনা শাসকরা সব সময় তাদের কথা শুনে না, এরশাদের মাধ্যমে তাদের সেই শিক্ষা হয়ে গেছে। আমেরিকা পাকিস্তান ভাগ করতে প্রথম জাতীয়তাবাদের চেতনাউস্কে দিয়েছিলো, সেই আমেরিকা এবার নতুন মোড়কে নিয়ে আসে নতুন চেতনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। কারণ আমেরিকার ভয় ছিলো শেখ হাসিনাকে দেশে নিয়ে এসেছে রুশব্লক। বঙ্গবন্ধূ কন্যা হওয়ায় রাশিয়া তাকে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিয়ন্ত্রণ নেয় নাকি, তখন ফের ক্ষমতা রাশিয়ার হাতে চলে যাবে। তাই ১৯৯২ সালে আমেরিকাই তার সদস্য জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে কিছু মার্কিনপন্থী নাস্তিকদের নিয়ে তৈরী করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ আদালত। শুরু হয়ে যায় চেতনা ব্যবসা। তবে জাহানারা ইমাম খুব তাড়াতাড়ি ক্যান্সারে মারা যাওয়ায় হাফ ছেড়ে বাচে শেখ হাসিনা। যে কথাটা সাবেক এপিএস মতিয়ুর রহমান রেন্টুর লেখা `আমার ফাঁসি চাই বইয়ে আছে- জাহানারা ইমাম মারা যাওয়ার পর শেখ হাসিনা আনন্দে নাচতে থাকে আর বলতে থাকেন মিষ্টি খাও, মিষ্টি। আমার একটা প্রতিদ্বন্দ্বী দুনিয়া থেকে বিদায় হয়েছে। আল্লাহ বাঁচাইছে। নেত্রী হতে চেয়েচিল। আমার জায়গা দখল করতে চেয়েছিল।জাহানারা ইমাম মারা গেলেও মার্কিন ব্লক সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চেতনা তৈরী অব্যাহত রাখে। চেতনা তৈরীবলছি এ কারণে, মুক্তিযুদ্ধ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, এই ঘটনার বিচার হবে ইতিহাসের ভিত্তিতে, কিন্তু মার্কিনপন্থীরা বানোয়াট গল্প কবিতা রচনা করতে থাকে, যার নেতৃত্বে থাকে হুমায়ুন আহমেদ, জাফর ইকবাল আর শাহরিয়ার কবিররা। সাথে ডিজিটাল মিডিয়ায় বিভিন্ন ডকুমেন্টারি নিয়ে আসে মার্কিন এজেন্ট তারেক মাসুদ আর ক্যাথরিন মাসুদরা। বলাবাহুল্য, মার্কিনীদের চেতনা চর্চার সহরাওয়ার্দী উদ্যানের সেই গণ আদালত২০১৩ তে হয়ে যায় শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ। শুরুতে সেটার নিয়ন্ত্রন থাকে মার্কিনী এজেন্ট ইমরান এইচ সরকার ও কথিত ব্লগার এন্ড অনলাইন এক্টিভিস্টদের হাতে, কিন্তু পরে সেটা রুশব্লকের আওয়ামীলীগ হাইজ্যাক করে তা ব্যবহার করতে চায়, ২০১৮ তে এসে শাহবাগ আন্দোলনের মূল মূল মার্কিনপন্থীদের জেলের ভাতও খাওয়ায় রুশব্লকের আওয়ামীলীগ, কয়েকজনকে বিদেশ আর কয়েকজনকে পরপারেও পাঠিয়ে দেয়া হয়।

যাইহোক, আবার পেছনের ইতিহাসে ফেরত যাই। ৯৬ এ রুশব্লকের আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় চলে আসে, ২০০১ এ মার্কিন-চীনব্লকের বিএনপি। ২০০৬ এ গিয়ে ফের আমেরিকা দেখে তাদের বিএনপি দিয়ে ঠিক পোষাচ্ছে না, তাদের আরো অনুগত সরকার দরকার, কারণ ততদিনে চীনের সাথে আমেরিকার সম্পর্কে ফাটল ধরে গেছে, চীন-আমেরিকা শত্রুতা শুরু হয়ে গেছে। ফলে এ অঞ্চলে তাদের তাদের পলিসি চেঞ্জ করতে হবে। তাই তারা উদ্যোগ নেয় হাসিনা-খালেদাকে মাইনাস-টু করে হিলারী বন্ধু ড. ইউনুসকে বসাবে। ভর করা হয় কিছু সেনা অফিসারের উপর। তাদের দিয়ে রাজনৈতিকদলগুলোর উপর উপর শক্তি প্রয়োগ করাও হয়। কিন্তু সে সময় হাল ধরে শেখ হাসিনার মূল চ্যানেল রুশব্লকের ভারতীয় কংগ্রেস। গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ মনমোহন সিং তার  আত্মজীবনীমূলক বই ওয়ান লাইফ ইজ নট এনাফ' স্পষ্ট লিখে কিভাবে সে শক্ত হস্তে শেখ হাসিনাকে ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় বসিয়েছে। ওয়ান ইলেভেনের পর মার্কিনপন্থীরা কিছু সেনা অফিসার দিয়ে তাদের যে প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে উদ্দত হয়েছিলো, তার খেসারত দিতে হয় রুশব্লকের শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে। কয়েক মাসের মধ্যে অর্থাৎ ২০০৯ সালে ঘটে যায় বিডিআর বিদ্রোহ। ঝরে যায় দেশের মহামূল্যবান অনেকগুলো সেনা অফিসারের প্রাণ।  মার্কিনপন্থীদের উপর প্রতিশোধ নেয় রুশব্লক।

এখন ২০১৮ সালের নির্বাচন উপস্থিত। এখনও একটা দলের উপর ভর করেছে রুশব্লকের ভারতীয় কংগ্রেস। অন্য দলের উপর আমেরিকার সিআইএ। মাঝখানে দুইপক্ষের মাঝে সক্রিয় আছে সুপার পাওয়ার হতে চলা চীন।

১৯৪৭ থেকে ২০১৮ হয়েছে, ৫১ বছরের ইতিহাস। সম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের মধ্যে স্বার্থ নিয়ে দ্বন্দ্ব করেছে, কিন্তু তারা ফিল্ডে নামেনি।  নামিয়ে দিয়েছে আমাদের। তাদের কোন ক্ষতি হয়নি, কেউ বলতে পারবে না, এখানে একজন মার্কিন সৈণ্য বা রাশিয়ার সৈণ্য মারা গেছে। মারা গেছে অসংখ্য বাংলাদেশী, এক ভাই আরেকভাইকে মেরেছে, ভাইয়ের রক্তে রক্তাক্ত করেছে নিজের হাত। বলি হয়েছে সম্রাজ্যবাদীদের প্রক্সিওয়্যারের।

বহুদিন তো হলো, আর কত? বহু রক্ত তো গেলো, আর কত আপন ভাইয়ের রক্ত চাই? জাতি আজ আওয়ামীলীগ-বিএনপিতে বিভক্ত। আসলে আওয়ামীলীগ আমাদের শত্রু নয়, বিএনপিও আমাদের শত্রু  নয়। শত্রু হলো তাদের উপর যারা ভর করেছে তারা। আমরা জনগণ যে দিন আওয়ামীলীগ-বিএনপির পর্দা ভেদ করে উপরের শত্রুদের দিকে তাকাতে পারবো, সেই দিন আমদের সামনে সব উন্মোচিত হবে। আমরা বুঝবো আওয়ামী-বিএনপি মারামারি নয়, আমাদের মারামারি করতে হবে পর্দার অন্তরালে দাড়িয়ে থাকা শত্রুদের সাথে, স্বার্থ নিয়ে টানাটানি করতে হবে তাদের সাথে। তখন তৈরী হবে জনগনের পক্ষ বা তৃতীয় পক্ষ।

গত কয়দিনে রাজনৈতিকদলগুলো তাদের ইশতেহার দিয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, সে ইশতেহারগুলোতে খুব সামান্যই আছে জনগণের চাওয়া-পাওয়া। বেশিরভাগ হলো সম্রাজ্যবাদীদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন এবং প্রতিপক্ষকে দমন করার কৌশল। কিন্তু কিভাবে জনগণের ভালো হবে, জনগণের উন্নতি হবে, সেটা খুব কমই বর্ণিত আছে সেই ইশতেহারগুলোতে। তবে এটার দোষ রাজনৈতিকদলগুলোকে আমি দেবো না, দেবো জনগণকে। জনগণ যেদিন প্রকৃতঅর্থেই নিজের ভালো বুঝবে, বুঝতে পারবে সম্রাজ্যবাদীদের প্রক্সিওয়্যারে হাওয়া না লাগিয়ে জনগণের পক্ষে হাওয়া লাগনো উচিত, সেদিন তৈরী হবে জনগণের পক্ষ বা তৃতীয় পক্ষ, সেই সময়ের অপেক্ষায়।

বিঃদ্রঃ আমি একটা ইশতেহারের দাবি তুলেছি, যার নাম ইশতেহারঃ জেগে ওঠো বাংলাদেশ ২০১৮। যেখানে আমি চেষ্টা করেছি শুধু জনগণের পক্ষ হয়েই দাবি তুলতে।


সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুনঃ

এডমিন

আমার লিখা এবং প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা সম্পূর্ণ বে আইনি।

0 ফেইসবুক: