Friday, October 5, 2018

৬৫’র যুদ্ধে ব্যর্থতার পর আইয়ূব খানের পুনর্জীবন লাভ, ছয় দফার হাক্বীক্বত ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি (১)


ইতিহাস দুপ্রকার, প্রচলিত ইতিহাস ও বাস্তব ইতিহাস। প্রচলিত ইতিহাস তৈরী হয় শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্য, জনগণের মগজ ধোলাইয়ের জন্য, যার মাধ্যমে কখনোই প্রকৃত সত্য উন্মোচিত হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাস্তব ইতিহাস হয় নিষিদ্ধ ইতিহাস, সরকার কর্তৃক তার প্রচার নিষিদ্ধ হয়। অর্থাৎ বাস্তব ইতিহাস হলো মুখ, আর প্রচলিত ইতিহাস হচ্ছে তাকে আড়াল করে রাখা মুখোশ।

আমাদের জাতীয় জীবনের ইতিহাসে ছয় দফার ভূমিকা অপরিসীম। প্রচলিত ইতিহাস অনুযায়ী এর মাধ্যমেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দাবি উত্থাপিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু যদি বলা হয় যে, ছয় দফা উত্থাপিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বার্থে নয়, বরং আইয়ূব খানের শাসনকাল দীর্ঘায়িত করার জন্য? বাস্তব ইতিহাস কিন্তু তা-ই বলে থাকে।

৬৫র যে পাক-ভারত যুদ্ধ, তা সংঘটিত হয়েছিল কাশ্মীরের বিরোধকে কেন্দ্র করে। যুদ্ধে আইয়ূব খান জনগণের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল কাশ্মীরকে পাকিস্তানে এনে দেয়ার। কিন্তু শেষপর্যন্ত আইয়ূব খান তৎকালীন কমিউনিস্ট রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের আমন্ত্রণে ভারতের সাথে অস্ত্রবিরতি চুক্তি সম্পাদন করে। তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্ভূক্ত তাসখন্দে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়। যেই কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ, চুক্তিতে সেই কাশ্মীরের নামও উল্লেখ করা হয়নি।

এতে করে পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের জনগণ তীব্র আইয়ূববিরোধী হয়ে উঠে, কারণ ভারত পশ্চিম পাকিস্তানেই মূল আক্রমণ করেছিল, বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানে কোনো আক্রমণ হয়নি। তৎকালীন সময়ের একজন উল্লেখযোগ্য রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খান রচিত স্বৈরাচারের দশ বছরবইতে সে সময়কার ঘটনাবলীর উল্লেখ রয়েছে। তিনি ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের চীফ মিনিস্টার। তিনি তার বইয়ের ৩৫৪-৩৫৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেনঃ

পশ্চিম পাকিস্তানে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অসংখ্য শহর বাজার গ্রাম ধ্বংস হয়েছে। বিদেশ থেকে আমদানী করা অতি মূল্যবান অস্ত্রশস্ত্র ধ্বংস হয়ে গেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেরা সৈনিক নিহত হয়েছেন। পৃথিবীর কোনো যুদ্ধে নাকি এত অল্প সময়ে এত অফিসার নিহত হয় নাই। তাদের স্থান পূরণ করা সম্ভব হবে না।

তাই, পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত বিরূপ। এত ক্ষয়ক্ষতির পর আয়ুব খাঁ সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে অপমানজনক একটি ঘোষণায় স্বাক্ষর করলেন। যে সব সৈনিক কর্মচারী শহীদ হয়েছেন তাদের বিধবা স্ত্রী ও পরিবারবর্গ এক মিছিল বার করল লাহোর শহরে। ধ্বনি তুলল, আমাদের স্বামী পুত্র ফেরত দাও।

১৯৫৮ সালে আইয়ূব খান ক্ষমতায় আসার পরই সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে এবং রাজনীতিবিদদের ক্ষমতাচ্যুত করে। সমগ্র দেশে সেনাবাহিনী কর্তৃক রাজনীতিবিদদের সমালোচনা শুরু হয়ে যায় এই বলে যে, এদের দিয়ে পাকিস্তানের কোনো উন্নতি হবে না, সুতরাং এদেরকে পদচ্যুত করে সেনাশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আলোচ্য বইয়ের লেখক আতাউর রহমান খানও পূর্ব পাকিস্তানের চীফ মিনিস্টারপদ হারায় আইয়ূব খানের সেনাশাসনের ফলে।

সুতরাং পঁয়ষট্টির যুদ্ধের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিকে তৎকালীন রাজনীতিবিদরা সেনাশাসনের বিরুদ্ধে বিরাট সুযোগ হিসেবে ধরে নিল। যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তান ছিল আইয়ূব খানের বিশেষ বিরোধী, সে কারণে লাহোরে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দ কর্তৃক ডাকা হলো নিখিল পাকিস্তান জাতীয় কনফারেন্স। এই সম্মেলন প্রসঙ্গে আতাউর রহমান খান তার বইয়ের ৩৫৫-৩৬০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেনঃ

জামাত, নিজাম ও কাউন্সিল লীগ যোগদানের সম্মতি দিল। আওয়ামী লীগের দোমনাভাব। শেখ মুজিবের মতামতই দলের মত। প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন অভিমত নাই। শেখ মুজিব কনফারেন্সে যোগদানে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেন।...

পরদিন সংবাদপত্রে দেখি, শেখ মুজিব সদলবলে লাহোর যাচ্ছেন। প্রায় চৌদ্দ পনেরো জন এক দলে। ব্যাপার কি? হঠাৎ মত পরিবর্তন! মতলবটা কি?

লাহোর কনফারেন্স শুরু হল গভীর উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে। অধিবেশন চলাকালে শেখ মুজিব হঠাৎ একটি বোমা নিক্ষেপ করলেন-ছয় দফা। এই দাবী যত গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন, এই সম্মেলন ও এই সময় তার উপযোগী নয়-সম্পূর্ণ অবান্তর।

লাহোর কনফারেন্স বানচাল হয়ে গেল। নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবকেই এর জন্য বিশেষভাবে দায়ী করেন। তাঁরা অভিযোগ করেন, শেখ মুজিব সরকার পক্ষ থেকে প্ররোচিত হয়ে এই কর্ম করেছেন। লাহোর পৌঁছার সাথে সাথে আয়ুব খাঁর একান্ত বশংবদ এক কর্মচারী শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করে কি মন্ত্র তার কানে ঢেলে দেয় যার ফলেই মুজিব সব উলটপালট করে দেয়। তারা এও বলে যে আওয়ামী লীগের বিরাট বাহিনীর লাহোর যাতায়াতের ব্যয় সরকারের নির্দেশে কোন একটি সংশ্লিষ্ট সংস্থা বহন করে। আল্লাহু আলীমুল গায়েব।

লাহোর কনফারেন্সের নিস্ফলতা পাকিস্তানের রাজনীতির ইতিহাসের একটা কলঙ্কময় অধ্যায়। সে দিন পরিস্থিতি এমনি উত্তেজনাপূর্ণ ছিল যে কনফারেন্স সাফল্যের সাথে সম্পাদিত হলে দেশময় যে বিরাট বৈপ্লবিক আন্দোলন শুরু হয়ে যেত, তার মুখে সরকারের টিকে থাকা দায় হতো। নেতৃত্বের কোন্দলে সরকারই একমাত্র লাভবান। সরকার আরও স্থিতিশীলতা লাভ করল।

উল্লেখ্য, আতাউর রহমান খান কর্তৃক স্বৈরাচারের দশ বছরগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭০ সালে। তখনও কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়নি, ফলে শেখ মুজিব তখনও কিংবদন্তী নেতার আসনে সমাসীন নন। সুতরাং উপরোক্ত বর্ণনাগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাছাড়া আতাউর রহমান খান নিজেই ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা নেতা, ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন দলটির সহসভাপতি।

আমরা জানি যে, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার পরও শেখ মুজিবকে ক্ষমতা দেয়া হয়নি। প্রচলিত ইতিহাসে একে উল্লেখ করা হয় পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক বাঙালিদের ক্ষমতা না দিতে চাওয়ার ইচ্ছাকে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, সাতচল্লিশে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে আটান্নতে আইয়ূব সরকার ক্ষমতায় আসার আগপর্যন্ত এই দশ-এগারো বছর সময়ের মধ্যেই তিনজন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে। তারা হলেন খাজা নাজিমুদ্দীন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বগুড়ার মুহম্মদ আলী। সুতরাং নিছক বাঙালিবিদ্বেষ নয়, শেখ মুজিবকে ক্ষমতা না দেয়ার নিশ্চয়ই অন্য কোনো কারণ উপস্থিত ছিল।

শেখ মুজিবকে ক্ষমতা না দেওয়ার জন্য যাকে মূল দায়ী করা হয়, সেই জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিল আইয়ূব সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ৬৫র যুদ্ধের পর ভারতের সাথে অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে তার কোনই সম্মতি ছিল না। কিন্তু আইয়ূব খানের জোরাজুরিতে সে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সোভিয়েত রাশিয়ার তাসখন্দে গিয়ে চুক্তি করে আসে এবং এর পরপরই সে আইয়ূব খানের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে। পরবর্তীতে পাকিস্তানের আইয়ূববিরোধী আন্দোলনে সে পশ্চিম পাকিস্তান অংশে মূল ভূমিকা পালন করে।

উল্লেখ্য, সত্তরের নির্বাচন ছিল আইয়ূব খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার ফসল। এখন লাহোর কনফারেন্স বানচাল করে আইয়ূব খানের সেনাশাসনকে স্থিতিশীলতাদান করেছিলেন শেখ মুজিব, আইয়ূববিরোধী হিসেবে জুলফিকার আলী ভুট্টো তা ভালো করেই জানতো। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিটি রাজনীতিবিদ ছিল এ কারণে শেখ মুজিবের প্রতি রুষ্ট। সুতরাং তারা স্বাভাবিকভাবেই আইয়ূব খানের ক্ষমতাচ্যুতির পর শেখ মুজিবের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়াটা চাইবে না। এছাড়াও আতাউর রহমান খান তার বইতে শেখ মুজিবের আরেকটি কীর্তি আলোচনা করেছেন, তা হলো হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গঠিত আইয়ূব সরকার বিরোধী ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টবা এনডিএফভেঙে দেয়া। (আগামী পর্বে সমাপ্ত)

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুনঃ

এডমিন

আমার লিখা এবং প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা সম্পূর্ণ বে আইনি।

0 ফেইসবুক: