Thursday, July 21, 2022

পবিত্র ইয়াওমুল জুমু’আহ ২২-ই জিলহাজ্জ শরীফ, ১৪৪৩ হিজরির বয়ান

أَعُوْذُ بِاللّٰهِ مِنَ الشَّيْطٰانِ الرَّجِيْمِ - بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

رَبِّ اشْرَحْ لِى صَدْرِى وَيَسِّرْ لِىٓ أَمْرِى وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِّن لِّسَانِى يَفْقَهُوا قَوْلِى

سُبْحَانَ اللہِ وَالْحَمْدُ لِلّٰہِ وَ لآ  اِلٰہَ اِلَّا اللہُ وَاللہُ اَکْبَرُ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّۃَ اِلَّا بِاللہِ الْعَلِیِّ الْعَظِیْمِ

اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَلَىٰ سَيِّدِنَا وَمَوْلَانَا مُحَمَّدٍ مَعْدَنِ الْجُوْدِ وَالْكَرَمِ وَ عَلَى آلِهٖ وَبَارِكْ وَسَلِّمْ

মসজিদে উপস্থিত সম্মানিত মুসল্লিয়ানে কেরাম সহ পর্দার অন্তরালে থাকা মা-বোনদের প্রতি (السَّلَامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ ٱللهِ وَبَرَكَاتُهُ)  আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহ।

আজ পবিত্র ইয়াওমুল জুমু’আহ শরীফের দিন, মুমিনদের সাপ্তাহিক ঈদের দিন। আজ ২২-ই জিলহাজ্জ শরীফ ১৪৪৩ হিজরী। গত সপ্তাহে আমরা পবিত্র বিদায় হজ্জের খুৎবা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আজ আমরা এই মাসে ঘটে যাওয়া বাকি প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো, ইন’শা-আল্লাহ।

১) হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালাম কর্তৃক প্রেরিত সেনাবাহিনী দ্বারা মিশর জয় করা হয়েছিল।

২) হযরত উসমান ইবনুল আফফান রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালাম তৃতীয় খলিফা হিসেবে নিযুক্ত হন।

সম্মানিত "বাইয়াতে-আকাবা" মুবারক এই মাসেই অনুষ্টিত হয়।

৩) সাইয়্যিদাতু নিসাই আহলিল জান্নাহ হযরত ফাতিমাতুজ্জ যাহ্‌রা আলাইহাস সালাম এই পবিত্র মাসে চতুর্থ খলিফা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালামের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

৪) হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালাম কাফের আবু লুলু দ্বারা ২৩ হিজরির ২৬শে জিলহজ্জে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ১ মুহররম শরীফে শাহাদাৎ বরন করেন

৫) হযরত উসমান ইবনুল আফফান রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালাম শহীদ হনঃ ৩৫ হিজরির ১৮ই জিলহজ্জে।

সর্বপ্রথম ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালামের আদেশে হযরত আমর ইবনুল আস রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে চার হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী নিয়ে মুসলিমগণ মিশরে আসেন। মূলত “মিশর বিজয়” হলো গায়েবের খবর দেনে ওয়ালা নবি মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম একটি মুজেজা, যা দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালামের যামানায় প্রকাশিত হয়। হাদিসে এসেছেঃ (عَنْ أَبِي، ذَرٍّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ إِنَّكُمْ سَتَفْتَحُونَ مِصْرَ وَهِيَ أَرْضٌ يُسَمَّى فِيهَا الْقِيرَاطُ فَإِذَا فَتَحْتُمُوهَا فَأَحْسِنُوا إِلَى أَهْلِهَا فَإِنَّ لَهُمْ ذِمَّةً وَرَحِمًا ‏"‏ ‏.‏ أَوْ قَالَ ‏"‏ ذِمَّةً وَصِهْرًا فَإِذَا رَأَيْتَ رَجُلَيْنِ يَخْتَصِمَانِ فِيهَا فِي مَوْضِعِ لَبِنَةٍ فَاخْرُجْ مِنْهَا ‏"‏ ‏.‏ قَالَ فَرَأَيْتُ عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ شُرَحْبِيلَ بْنِ حَسَنَةَ وَأَخَاهُ رَبِيعَةَ يَخْتَصِمَانِ فِي مَوْضِعِ لَبِنَةٍ فَخَرَجْتُ مِنْهَا) হযরত আবূ যার গিফারী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ শীঘ্রই তোমরা মিশর বিজয় লাভ করবে। সেটা এমন একটি দেশ, যেখানে “কীরাত” নামে মুদ্রা খ্যাত। তোমরা যখন সে দেশ বিজয় লাভ করবে তখন সেখানকার অধিবাসীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করবে। কারণ তাদের জন্য দায়িত্ব ও আত্মীয়তার সম্পর্ক (যেহেতু মিশরীয়রা ইসমাঈল আলাইহিস সালামের বংশধারা) বিদ্যমান রয়েছে। কিংবা তিনি বলেছেনঃ যিম্মাদারী ও বৈবাহিক সম্পর্ক রয়েছে। তোমরা যখন সেখানে দু’লোককে একটি ইটের স্থান নিয়ে বিবাদ করতে দেখবে তখন সেখান থেকে চলে আসবে। আবূ যার রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তারপর আমি যখন আবদুর রহমান ইবনু শুরাহবীল ইবনু হাসান ও তার ভাই রাবী’আকে একটি ইটের স্থান নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ করতে দেখলাম তখন আমি সেখান থেকে চলে আসলাম। (মুসলিম শরীফঃ ইঃফাঃ ৬২৬৩, ইঃসেঃ ৬৩১২, আঃনাঃ ২৫৪৩বি)

উক্ত হাদিসের অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালামের আদেশে ৬৩৯ সনের শেষের দিকে আমর ইবনুল আস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ‘সিনাই উপত্যকা’ পাড়ি দেন উনার সাথে থাকা ৪,০০০ সৈন্যে নিয়ে। তিনি উনার প্রথম সাফল্যে ঈদ উৎযাপন করলেন ১২ ডিসেম্বর ৬৩৯ সনে ‘আরিশ’ এর ‘পিলগ্রিমাগা’য়। কিন্তু খুব দ্রুত তিনি পাল্টা আক্রমণের মুখে পড়লেন। বিলবিসের নিকট থেকে বাজেন্টাইনরা ‘টাউন অফ পেলসিয়াম’ বা আল-ফারামায় আমর ইবনুল আস রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর উপরে আক্রমণ চালায়। আমর ইবনুল আস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু সিরিয়াবাসীদের নিকট থেকে সাহায্য পেলেন। উনার সৈনবাহিনীতে ৬-ই জুন ৬৪০ এ সিরিয়া হতে ১২ হাজার সৈন্য যোগ দিল। তিনি ‘আলেকজান্দ্রিয়া’ ‘মেম্ফিস’ ‘হেলিপোলিস’ জয় করলেন। ৬৪১ সনে উনার লক্ষ্য পূরণে পুরোপুরি সফল হলেন।

পুরো নতুন এই রাজ্যে শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন রাজধানীর প্রয়োজন ছিল। আমর ইবনুল আস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু খলিফা হযরত উমর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালামের কাছে প্রস্তাব পাঠালেন, খলীফা কতৃক তা গৃহীত হলে ‘ব্যাবিলন দুর্গে’র কাছে আমর ইবনুল আস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু একটি নতুন শহর তৈরি করেন এবং সেখানে মিশরের প্রথম মসজিদ ‘মসজিদে আমর ইবনুল আস’ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজো পুরনো কায়রোতে বিদ্যমান রয়েছে।

মুসলিম শাসকগণ মিশরে সুন্নী ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলিমদের যুগে অমুসলিম মিশরীয়রা তাদের পূর্বের পৌত্তলিক বিশ্বাস, খ্রিস্টবাদী বিশ্বাসের সাথে অনেকটা মিশ্রভাবে ইসলামি বিশ্বাসকে পালন করতে থাকে। (দেখুন)

ড. ইসা মাহদী তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেনঃ বর্ণিত আছে, একবার মদীনার কোথাও আগুন লাগলে হযরত উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালাম আগুনকে চিরকুট লিখে দেন, “হে আগুন মহান আল্লাহ তা’আলার হুকুমে নিভে যাও” এবং সত্যি সত্যিই তখন আগুন নিভে যায়। 

তাছাড়া তারিখে ইসলামে পাওয়া যায়, “মিশরের নীল নদে প্রতিবছর একজন করে সুন্দরী যুবতীকে হত্যা করে রক্তে রঞ্জিত করা হত, যেন নীল নদ বহমান থাকে। অন্যথায় নীলনদ শুকিয়ে যেত। হিজরি ২০ সাল, হযরত উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালাম এর শাসনকাল। মিশর জয় করলেন হযরত আমর ইবনুল আস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু। মিশরে তখন প্রবল খরা। পানিশূণ্য মিশরের নীল নদ। সেনাপতি হযরত আমর ইবনুল আস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু মিশরের অধিবাসীদের জিজ্ঞাস করলেন, নীল নদের এমন অবস্থা কেন?

তারা বললেন, হে আমির! নীল নদে বছরের একটি সময় পানি প্রবাহিত হয়, বাকি সময় নীল নদ পানি শূন্য থাকে, তবে নদীতে কুমারি সুন্দরি যুবতি কন্যা উৎসর্গ করলে দেবতার আশীর্বাদে নীল নদ আবার পানিতে ভরে উঠবে। হযরত আমর ইবনুল আস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ইসলামে এই কাজের কোন অনুমোদন নেই। ইসলাম প্রাচীন সব মূর্খ রীতি-নীতিকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে।

সেনাপতির নির্দেশে সুন্দরী কন্যা উৎসর্গ থেকে বিরত থাকলেন মিশরবাসীরা। তিনমাস পার হয়ে গেলেও পানি শূন্য নীল নদ। জীবন যাবন দুর্ভোগময়। মিশর অধিবাসীরা দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন। এ অবস্থা দেখে হযরত আমর ইবনুল আস খলিফা হযরত উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালামকে চিঠি লেখেন। সেনাপতির পত্র পেয়ে খলিফা উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালাম নীল নদকে উদ্দেশ্য করে একটি পত্র লেখেন, “মহান আল্লাহ তা’আলার বান্দা আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমরের পক্ষ থেকে মিশরের নীল নদের প্রতি প্রেরিত এই পত্র। হে নীল নদ! তুমি যদি নিজের ক্ষমতা বলে ও নিজের পক্ষ থেকে প্রবাহিত হয়ে থাক, তাহলে তুমি আর আজ থেকে প্রবাহিত হইয়ো না। তোমার কাছে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। আর তুমি যদি মহা পরাক্রমশালী এক আল্লাহ তা’আলার নির্দেশে প্রবাহিত হয়ে থাক, তাহলে আমরা মহান আল্লাহ তা’আলার কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন তোমাকে প্রবাহিত করেন”।

আমর ইবনুল আস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু যখন নীল নদের তীরে গিয়ে খলীফা হযরত উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালামের পত্রটি নদীতে নিক্ষেপ করেন। পরদিন শনিবার থেকেই জেগে ওঠে নীল নদ। সকালে মিশরবাসী অবাক নয়নে দেখেন, মহান আল্লাহ তায়ালা এক রাতে নীল নদের পানিকে ১৬ গজ উচ্চতায় প্রবাহিত করে দিয়েছেন। চকচকে ঝকঝকে পানিতে ভরে উঠে নীল নদ। সেই থেকে আজ পর্যন্ত শুকায়নি নীল নদ। এক মিনিটের জন্যও। সুবহানআল্লাহ!!!

২৩ হিজরির এই পবিত্র মাসেই খলীফা হযরত উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালাম ২৬শে জিলহজ্জে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ১ মুহররম শরীফে শাহাদাৎ লাভ করেন।

হযরত উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালামের খেলাফত আমলে হিজরি ২১ মোতাবেক ৬৪২ সালে বিখ্যাত সাহাবি হজরত হোজায়ফা ইবনুল ইয়ামান রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে পরিচালিত নেহাবন্দ যুদ্ধে অবিস্মরণীয় বিজয়ের মাধ্যমে সাসানী সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। সাসানী বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল দেড় লাখ এবং মুসলিম বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০ হাজার। সাসানী সৈন্যদের মধ্যে ৩০ হাজার মারা যায়। আরবরা এ যুদ্ধের নাম দিয়েছে ফাতহুল ফুতুহ অর্থাৎ সেরা বিজয়। এ যুদ্ধে সাসানী বা পারস্য বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সৈন্য মুসলমানদের হাতে গ্রেফতার হয়। তাদের মধ্যে খলিফা হযরত উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালামের হত্যাকারী আবু লুলু নামক এক অগ্নিপূজারি নেহাবন্দবাসীও ছিল। আবু লুলু কেন খলিফা হযরত উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালামকে হত্যা করতে গেল, তার কারণ খলিফার নিকট তার মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রতিকার না পাওয়ার কথা সকল ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করা হলেও প্রকৃত কারণ যে ভিন্ন ছিল, সে কথা কোনো কোনো ইতিহাসে বলে দেওয়া হয়েছে। ঘটনার দুটি দিকই আমি নিচে উল্লেখ করতে চাই।

প্রথমতঃ বলতে হয় যে, আবু লুলু ছিল মজুসী (আগুন পূজারি) নেহাবন্ধ এলাকার অধিবাসী এবং সে নিজেও ছিল মজুসী মোশরেক। মজুসীরা ইসলাম ও মুসলমানদের চরমভাবে মনেপ্রাণে ঘৃণা করত। ইসলামের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা ও বিজয় অভিযানগুলো প্রত্যক্ষ করে মজুসী সাম্রাজ্যের শাসকরা সাম্রাজ্য হারানোর আশংকায় দারুণভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তাই মুসলমানদের সাথে প্রতিটি যুদ্ধের পূর্বে মুসলিম প্রতিনিধি দলগুলোর সাথে সাক্ষাতের সময় মজুসী শাসকরা নিজেদের রাজকীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রদর্শন ছাড়াও মুসলমানদের নিকৃষ্ট, হেয়প্রতিপন্ন করার অশোভন আচরণ করেছে, অহমিকা-অহংকারের জৌলুস দেখিয়েছে। অবশেষে নেহাবন্দ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর নিকট সাসানীদের বিশাল বাহিনীর চরম পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শত শত বছরের সাসানী সাম্রাজ্যের অবসান দেখে এ সাম্রাজ্যহারাদের ক্ষোভের আগুন, শির্কের আগুন নির্বাপিত না হয়ে বরং প্রজ্বলিত হতে থাকে। যারা পরিস্থিতির কারণে ইসলাম গ্রহণ করে, তারা অনেকে মনেপ্রাণে ইসলাম গ্রহন করতে পারেনি। তাদের মধ্যে এমন লোকের অভাব ছিল না, যারা সুযোগের অপেক্ষায় অথবা সন্ধানে ছিল, কীভাবে ইসলামের ক্ষতিসাধন করা যায়। নেহাবন্দ যুদ্ধে চরম বিপর্যয়ে তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। হাজারে হাজারে যারা মরেছে, তারা তো মরেছে, আর যারা কোনো প্রকারে প্রাণে বেঁচে যায় কিংবা মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়, তারা পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে জীবনযাপন করতে থাকে। তাদের মধ্যে যারা মনেপ্রাণে ইসলাম গ্রহণ করে এবং সত্যিকারের খাঁটি মুসলমান হয়ে যায়, তারা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে সৌভাগ্যের জীবন লাভ করে ধন্য হয়।

কিন্তু আবু লুলু একজন বিখ্যাত সাহাবি হজরত মুগীরা ইবনে শোবা রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর দুর্লভ সান্নিধ্যে থেকেও মুসলমান হওয়ার গৌরব লাভ করতে দারুণভাবে ব্যর্থ হয়। সে মজুসিয়াতের যে তিমিরে বেড়ে উঠেছিল সে তিমিরেই তার গোলামী জীবন অক্ষুন্ন রাখে। ইসলামের সর্বপ্রথম গুপ্তহত্যার সন্ত্রাস চালাতে গিয়ে সে আত্মহননের আরেক সন্ত্রাসের মাধ্যমে জাহান্নামের যাত্রী হয়।

হিজরি ২১/৬৪২ সালের ৯ মার্চ তারিখে নেহাবন্দ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে আবুলুলু গ্রেফতার হয়। হজরত মুগীরা ইবনে শোবা রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর গোলামীতে তার অবস্থানকাল দুই-আড়াই বছরের অধিক নয়। এ সময় সে মুসলমানদের সব অবস্থা ও মদিনার পরিস্থিতি উত্তম রূপে অবগত হতে পারে। পেশাজীবী হিসেবেও তার আর্থিক অবস্থা উত্তমই ছিল, কিন্তু সে মুসলমানদের আচার-আচরণ, চাল-চলন এবং তাদের ব্যবহারিক জীবনের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে তার মজুসী চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণা- বিশ্বাসের ওপর অটল থাকে। স্বাভাবিকভাবেই মনে করা সঙ্গত যে, মজুসী আবুলুলু ইসলামবিদ্বেষী মনমানসিকতা পোষণ করতে থাকে এবং ইসলামের ছিদ্র অনুসন্ধান ও সুযোগের অপেক্ষায় ইসলামের ক্ষতিসাধন কীভাবে করা যায়, তা নিয়েই ছিল তার চিন্তাভাবনা। ইতোমধ্যে সে ইসলামবিরোধী একটি চক্রও সৃষ্টি করে থাকলে তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা প্রবন্ধের শুরুতে যে দুটি দিকের উল্লেখ করেছি, এবার তার অপর দিকটি নিয়ে আলোচনা করা যাক, যার সাথে জড়িত রয়েছে আবু লুলুর লীলা খেলা। 

ঘটনাটি সকল ইতিহাস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে এবং বহুল প্রচলিত। ঘটনাটি নিম্নরূপঃ

নেহাবন্দের অধিবাসী ও মুগীরা ইবনে শোবা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু গোলাম আবু লুলু একদিন বাজারে আমিরুল মোমেনীর সাথে সাক্ষাৎ করে। অপর বর্ণনা অনুযায়ী, সে আমিরুল মোমেনীনের দরবারে উপস্থিত হয়। সে অভিযোগের সুরে বলেঃ আমার মুনিব আমার ক্ষমতার চেয়ে অধিক আমার ওপর মাসুল (কর) আরোপ করেছেন। আপনি তা কমিয়ে দিন। হজরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালাম জিজ্ঞাসা করলেনঃ তোমার মাসুল কত? সে বললঃ দৈনিক দুই দেরহাম। তিনি প্রশ্ন করলেনঃ তুমি কী কাজ কর? সে বললঃ ছুতারের কাজ, ভাস্কর্য এবং লৌহকর্ম। আমিরুল মোমেনীন বললেনঃ তোমার হাতে তিনটি পেশা রয়েছে। এ অবস্থায়ও তুমি অভিযোগ করছ। আমার মতে, তোমার পেশাগুলোর মোকাবিলায় তোমার উপর আরোপিত কর অধিক নয়।

কথা প্রসঙ্গে আমিরুল মোমেনীন আবু লুলুকে জিজ্ঞেস করলেনঃ আমি জানতে পেরেছি তুমি উৎকৃষ্ট চাকী বানাতে পার। জবাবে সে বললঃ জী, হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ তাহলে আমাকে একটি চাকী বানিয়ে দাও। আবু লুলু বললঃ আমি যদি বেঁচে থাকি, তাহলে এমন চাকী বানিয়ে দেব যার খ্যাতি পূর্ব-পশ্চিম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে। এ কথা বলে সে প্রস্থান করে। হজরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালাম বলেন এ গোলাম আমাকে হুমকি দিয়ে গেল। একটি তুচ্ছ বিষয়কে আবু লুলু যে ধৃষ্টতার সাথে গ্রহণ করে খলিফাকে হুমকি প্রদর্শন করে তাতে বোঝাই যায় যে, তার অভিযোগের আসল উদ্দেশ্যই ছিল ভিন্ন। সে অসৎ ও কুমতলব পোষণ করেই অভিযোগ করেছিল। খলিফার জবাব তার মনঃপূত হয়নি। খলিফা যখন তার কর্মকৌশলতার প্রশংসাসূচক কথা বলে খলিফার জন্য চাকী বানিয়ে দিতে বললেন তখন সে উনার কথার জবাবে আবু লুলু যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ উক্তি করে হুমকি প্রদর্শন করে তা তার বিকারগ্রস্ত মস্তিষ্কের উর্বর ফসল তো বটেই, সাথে সাথে তার বদ নিয়ত ও কুমতলবেরও পরিচায়ক। কোনো সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত এতে সক্রিয় ছিল তা পরবর্তীতে তার সন্ত্রাসী ও ধ্বংসাত্মক ভূমিকা হতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মজুসী আবু লুলু মোনাফেকি আচরণ করে নামাজি সেজে মসজিদে প্রবেশ করতে পর্যন্ত দ্বিধা করেনি। গভীর চক্রান্তের মাধ্যমে সে মহান খলিফার ওপর সন্ত্রাসী কায়দায় গুপ্ত হামলা চালায় এবং মসজিদে নববীর মর্যাদা ক্ষুন্ন করে। তার চক্রান্তের প্রমাণ রয়েছে নিম্নে বর্ণিত ঘটনায়ঃ

আবদুর রহমান ইবনে আবি বকর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে, ঘটনার পূর্ব রাতে তিনি হরমুজান জাফনিয়া নাসরানী এবং আবু লুলুকে পরস্পর কান কথা বলতে দেখেছেন। তাদের দৃষ্টি যখন উনার প্রতি পড়ে তখন তারা বিচলিত হয়ে পড়ে। এ বিচলিত অবস্থায় তিনি ওদের একজনের হাত হতে একখানা খঞ্জর ছুটে মাটিতে পড়তে দেখেন। খঞ্জর দুই ধার বিশিষ্ট ছিল যা দেখতে অবিকল সেই খঞ্জর যা দ্বারা আবু লুলু আমিরুল মোমেনীনের ওপর হামলা চালিয়েছিল। আবদুর রহমান ইবনে আবি বকর রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর এ প্রত্যক্ষ ঘটনা প্রমাণ করে যে, হজরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালামের সাথে আবু লুলুর কথোপকথনের পরবর্তী ঘটনা এটি। ওই ঘটনার পর আবু লুলু বসে থাকেনি, আরো দুজনকে তার সঙ্গে ভেড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে।

আবু লুলুর গোপন ষড়যন্ত্রের সাথে কতজন জড়িত ছিল, তা জানা না গেলেও অপর দুজনের পরিচয় বলে দেয় যে, হজরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালামকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। হরমুজান ইসলাম গ্রহণ করার পরও কেন এ ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো, এ প্রশ্নের জবাবও সহজ। সে ইরানী সেনাপতি হিসেবে মুসলমানদের হাতে প্রতিটি যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পূর্বে ইরাকের জমিদার ও কৃষকদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত ও উসকে দেওয়ার অনবরত চেষ্টা চালিয়েছিল এবং ততক্ষণ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেনি যতক্ষণ না তার নিশ্চিত বিশ্বাস হয়েছে যে, তার মৃত্যু অবধারিত, কেবলমাত্র ইসলামই তার রক্ষাকবচ। তাই বার বার মুসলমানদের সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেও প্রতিবারই চুক্তি ভঙ্গ করতে থাকে। কারণ সে কখনো ভুলতে পারেনি যে, মুসলমানদের হাতে সাসানী সাম্রাজ্যের পতনের মূলে রয়েছে হজরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালামের বিরাট ভূমিকা। সুতরাং তাকে খতম করতে হবে। জাফিনিয়া নাসরানী নাজরানের অধিবাসী ছিল। হযরত সাদ ইবনে আবি ওক্কাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাকে একটি মহৎ উদ্দেশ্যে নিয়ে এসেছিলেন। আর তা হচ্ছে এই যে, সে লোকদেরকে লেখাপড়া শিখাবে। সে সময়ের কথা, যখন হজরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালাম ইরানী ও রোমানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত, তখন নাজরানের খৃস্টানদেরকে জাজিরাতুল আরব হতে বহিষ্কার করেন এবং তাদের স্থান পরিবর্তনের ক্ষতিপূরণ দিয়ে সিরিয়া এবং ইরাকে পুনর্বাসিত করেন। তাই তার আশঙ্কা ছিল যে, এমন নাজুক পরিস্থিতিতে এসব লোক অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে পারে। অতঃপর মুসলমানগণ রোমের হিরাক্লিয়াসের বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। হিরাক্লিয়াস ছিলেন খৃস্টান। তাই এটা খুবই সম্ভব যে, জাফনিয়া নাসরানী খৃস্টান ও অন্তরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করত এবং এটাও সম্ভব যে, সে হরমুজানকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে তার সাথে একাত্ম হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। আবু লুলুর কথা আগেই বলা হয়েছে। এ তিন চক্রান্তকারী ছাড়াও ইতিহাসে আরেকজনের নাম পাওয়া যায়, সে হচ্ছে কাবুল আহবার। তার সম্পর্কে যে বিবরণ পাওয়া যায় তার সারাংশ হচ্ছেঃ আমিরুল মোমেনীনের ওপর আবু লুলু কর্তৃক হামলা চালানোর তিন দিন আগে সে উনার খেদমতে উপস্থিত হয়ে জানান যে, তিন দিনের মধ্যে আপনার মৃত্যু হবে। হজরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালাম জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কীভাবে জানলে? কাবুল আহবার বললঃ আমি কিতাবুল্লাহ (তওরাত) হতে জেনেছি। হজরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালাম বললেনঃ উমরের কি সৌভাগ্য যে তওরাতে তার উল্লেখ রয়েছে। কাবুল আহবার বললেন, আসল ব্যাপার হচ্ছে এই যে, আপনার গুণ পরিচয় ও হুলিয়ার উল্লেখ তাতে অবশ্যই রয়েছে। সেদিন সে এসব কথা বলে চলে যায়। দ্বিতীয় দিন এসে বললঃ আপনার মৃত্যুর আর দুই দিন বাকি আছে। পরের দিন এসে বললঃ আর একদিন এক রাত বাকি আছে। কাল সকালে আপনার মৃত্যু হবে। কাবুল আহবার চলে যাওয়ার পর দিন সত্যি সত্যিই হজরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালাম আবু লুলু কর্তৃক আক্রান্ত হন এবং তিন দিন পর তিনি শাহাদাতবরণ করেন। এদিকে এ ঘটনার ফলে সাধারণ লোকদের মধ্যে পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস জন্মে যে, যেসব ভিত্তিহীন ইসরাইলি কাহিনী কাবুল বলে থাকে সবই সত্য। কাবুল বর্ণিত এসব কাহিনী সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তার বহু মনগড়া ভিত্তিহীন কাহিনী অনেকে ইতিহাস এবং হাদিস ও তাফসির গ্রন্থসমূহে অন্তর্ভুক্ত করেন। কাবুলের খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়ে। কাবুল ছিল একজন ইহুদি আলেম, সে তওরাতকে ইবরানী অর্থাৎ ইহুদিদের প্রাচীন ভাষায় পড়ত। ইসলাম গ্রহণের পর তার একটা আলাদা মর্যাদা হয়ে যায়। তার মনগড়া অনেক কাহিনী মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত হয়ে যায়। এগুলো ইসরাইলিয়াত নামে খ্যাত। হজরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালামের মৃত্যু সম্পর্কে তার কথাগুলোও ছিল কল্পিত মনগড়া। তবে বর্ণিত তিন কুচক্রীর ষড়যন্ত্রের সাথে তার নিবিড় সম্পর্কের কারণে খলিফাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের কথা জানত বলেই সে যে চালাকির সাথে খলিফাকে উনার মৃত্যু সংবাদ আগাম জানিয়ে দেয়, ষড়যন্ত্রের কথা গোপন রাখে। হিজরি ২৩ সালের ২৬ জিলহজ্জ হজরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালাম প্রতিদিনকার মতো নিয়মিত ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে গমন করেন। ইমামতী করার জন্য আল্লাহু আকবার বলে নিয়ত করার সাথে সাথে মুগীরা ইবনে শোবা রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর গোলাম আবু লুলু লানতুল্লাহ খঞ্জর হাতে অগ্রসর হয়, সে নামাজিদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আকস্মিক ভাবে সে দোধারী খঞ্জর দ্বারা আমিরুল মোমেনীনের ওপর পর পর ছয়টি আঘাত করে। একটি আঘাত নাভির নিচে লাগে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তিনি আবদুর রহমান ইবনে আওফ রদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে নামাজের ইমামতি করার জন্য বলেন। আহত খলিফা জমিনে ঠেক দিয়ে নামাজ আদায় করেন, অপরদিকে ঘাতককে পলায়নরত অবস্থায় লোকেরা ধরে ফেলে। ঘাতক মুশরিক মজুসি নিজের মৃত্যু অবধারিত দেখে আত্মহত্যা করে। মারাত্মক আহত খলিফাকে উনার গৃহে নিয়ে যাওয়া হয় এর ৩ দিন পর তিনি শাহাদাতবরণ করেন। শুধু উনিই না, ইসলামের তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান ইবনে আফফান রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আলাইহিস সালাম ও এই মাসেই শহীদ হোন, ইন’শা-আল্লাহ আগামী সপ্তাহে এই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।  

প্রতি সপ্তাহের মতো আজকেও সবাইকে আহ্বান করছি, অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হবে জুমু’আহ শরীফের খুৎবা, আর খুৎবার আযান থেকে শুরু করে নামায চলাকালীন সময়ে করা সকল হালাল ব্যবসাই মহান আল্লাহ পাক নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন, মহান আল্লাহ পাক বলেনঃ (یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا نُوۡدِیَ لِلصَّلٰوۃِ مِنۡ یَّوۡمِ الۡجُمُعَۃِ فَاسۡعَوۡا اِلٰی ذِکۡرِ اللّٰهِ وَ ذَرُوا الۡبَیۡعَ ؕ ذٰلِکُمۡ خَیۡرٌ لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ) হে ঈমানদারগণ! (পবিত্র) জুমু’আহ শরীফের দিনে যখন নামাযের জন্য (তোমাদের) আহবান করা হয় (অর্থাৎ যখন আযান দেওয়া হয়), তখন তোমরা মহান আল্লাহ তা’য়ালার স্মরণের দিকে (অর্থাৎ নামাযের উদ্যেশ্যে মসজিদের দিকে) ধাবিত হও। এবং (সকল ধরণের) বেচা-কেনা পরিত্যাগ কর, এটাই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম, যদি তোমরা (তা) বুঝতে পারো। (আল কুরআনঃ ৬২/৯)।

কুরআনের এই আয়াত দ্বারা জুমু’আহ শরীফের দিন খুৎবার আযানের সময় থেকে নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত সকল ধরণের ব্যবসা বাণিজ্যকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, তাই এই সময় দোকানপাঠ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে, ব্যবসা প্রতিষ্টানে তালা মেরে নামাযে উপস্থিত হতে হবে। এই সময় বেচাকেনা হারাম, আমাদের ফিকির করা উচিৎ যে, মাত্র আধা ঘন্টার জুমু’আহ নামাযের সময় আমরা কি এমন বেচাকেনা করছি, কি এমন লাভ করছি যে সামান্য কিছু টাকার জন্য সমস্ত উপার্জনটাই হারাম করে দিচ্ছি, কারণ ঐ মুহূর্তে করা এক টাকার ব্যবসাও বাকি টাকার সাথে মিলে সম্পূর্ণ টাকাই হারাম করে দিচ্ছে। আর হারাম উপার্জনে কখনোই মহান আল্লাহ তা’য়ালার বরকত থাকেনা, যার কারণে দিনশেষে দেখা যায় সারাদিন খেঁটেও ফায়দা হচ্ছেনা।

এর পরের আয়াতে মহান আল্লাহ পাক বলেনঃ (فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلٰوةُ فَانتَشِرُوا فِى الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِن فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ) অতঃপর নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে (অর্থাৎ জমিনে) ছড়িয়ে পড় এবং মহান আল্লাহ তা’য়ালার অনুগ্রহ (অর্থাৎ জীবিকা) তালাশ কর এবং মহান আল্লাহ তা’য়ালাকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা (জীবিকা উপার্জনে) সফলকাম হও। (আল কুরআনঃ ৬২/১০)।

আয়াতে পাকে, মহান আল্লাহ তা’য়ালা যে অনুগ্রহ তালাশের কথা বলেছেন, এর অর্থ দুনিয়াবি কাজ-কর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্য আবার শুরু করো। অর্থাৎ, জুমু’আর নামায শেষ করার পর তোমরা পূনরায় নিজ নিজ কাজে-কর্মে এবং দুনিয়ার ব্যস্ততায় লেগে যাও। তবে আমার স্মরণ থেকে গাফেল হয়োনা, বরং মনে মনে আমার যিকির করো আর কাজ কর্ম করতে থাকো। এছাড়াও একটি বিষয় পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, জুমু’আহ শরীফের দিন কাজ-কর্ম বন্ধ রাখা জরুরী নয়। কেবল নামাযের জন্য, নামাযের সময় তা বন্ধ রাখা জরুরী। মহান আল্লাহ পাক-এর এরূপ স্পষ্ট হুকুম জানার পরেও যারা এই হুকুম অমান্য করে ব্যবসা করবেন তারা ইচ্ছা অনিচ্ছা আর অজ্ঞতায় নিজেদের হালাল মালের মধ্যে হারাম কে মিশিয়ে দেবেন। আর হারাম মালের সংমিশ্রণের রিযিক দ্বারা গঠিত দেহ কখনোই জান্নাতে যাবেনা।

এছাড়াও যারা নিয়মিত নামায পড়েন, জুমু’আতে আসেন, তারা যেনো সুন্নাহ অনুসরণ করেই মসজিদে আসেন, এতে রহমত ও বরকতপ্রাপ্ত হবেন, শাওয়ার বা পুকুরে এক ডুইব দিয়েই যেকোন একটা পোশাক পরে জুমু’আর দুই রাকাত ফরজ নামায আদায়ের উদ্যেশে মসজিদে না এসে ভালো মতো প্রিপারেশন নিয়েই আসবেন। হাদিস শরীফে হযরত, (عَنْ سَلْمَانَ الْفَارِسِيّ رَضِیَ اللّٰہُ عَنۡہُ، قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ آلِهٖ وَسَلَّمَ  لاَ يَغْتَسِلُ رَجُلٌ يَوْمَ الْجُمُعَةِ، وَيَتَطَهَّرُ مَا اسْتَطَاعَ مِنْ طُهْرٍ، وَيَدَّهِنُ مِنْ دُهْنِهِ، أَوْ يَمَسُّ مِنْ طِيبِ بَيْتِهِ ثُمَّ يَخْرُجُ، فَلاَ يُفَرِّقُ بَيْنَ اثْنَيْنِ، ثُمَّ يُصَلِّي مَا كُتِبَ لَهُ، ثُمَّ يُنْصِتُ إِذَا تَكَلَّمَ الإِمَامُ، إِلاَّ غُفِرَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ الأُخْرَى) “হযরত সালমান ফারসী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যাক্তি জুমু’আর দিন গোসল করে এবং যথাসাধ্য ভালরূপে পবিত্রতা অর্জন করে এবং নিজের তেল থেকে ব্যবহার করে বা নিজ ঘরের সুগন্ধি ব্যবহার করে এরপর (নামাযের উদ্যেশ্যে) বের হয় এবং (মসজিদে প্রবেশ করে) দু’জন লোকের মাঝে ফাঁক না করে (যেখানে যায়গা পায় সেখানেই দাড়িয়ে যায়), অতঃপর তার নির্ধারিত নামায আদায় করে এবং ইমামের খুতবা দেওয়ার সময় চুপ থাকে, তা হলে তার সেই জুমু’আহ শরীফের (নামায) থেকে পরের জুমু’আহ শরীফের (নামাযের আগ) পর্যন্ত (মধ্যবর্তী) সময়ের (মধ্যে ঘটা) যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। (বুখারী শরিফঃ ইঃফাঃ ৮৩৯, আঃনাঃ ৮৮৩)

জুমু’আ শরীফের দিনকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নাই, না আছে সুযোগ জুমু’আর নামাযকে অবহেলার। হদিস শরীফে এসেছেঃ (عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ خَطَبَنَا رَسُولُ اللَّهِ ـ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ آلِهٖ وَسَلَّمَ ـ فَقَالَ ‏ "‏ يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إِلَى اللَّهِ قَبْلَ أَنْ تَمُوتُوا وَبَادِرُوا بِالأَعْمَالِ الصَّالِحَةِ قَبْلَ أَنْ تُشْغَلُوا وَصِلُوا الَّذِي بَيْنَكُمْ وَبَيْنَ رَبِّكُمْ بِكَثْرَةِ ذِكْرِكُمْ لَهُ وَكَثْرَةِ الصَّدَقَةِ فِي السِّرِّ وَالْعَلاَنِيَةِ تُرْزَقُوا وَتُنْصَرُوا وَتُجْبَرُوا وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ قَدِ افْتَرَضَ عَلَيْكُمُ الْجُمُعَةَ فِي مَقَامِي هَذَا فِي يَوْمِي هَذَا فِي شَهْرِي هَذَا مِنْ عَامِي هَذَا إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ فَمَنْ تَرَكَهَا فِي حَيَاتِي أَوْ بَعْدِي وَلَهُ إِمَامٌ عَادِلٌ أَوْ جَائِرٌ اسْتِخْفَافًا بِهَا أَوْ جُحُودًا بِهَا فَلاَ جَمَعَ اللَّهُ لَهُ شَمْلَهُ وَلاَ بَارَكَ لَهُ فِي أَمْرِهِ أَلاَ وَلاَ صَلاَةَ لَهُ وَلاَ زَكَاةَ لَهُ وَلاَ حَجَّ لَهُ وَلاَ صَوْمَ لَهُ وَلاَ بِرَّ لَهُ حَتَّى يَتُوبَ فَمَنْ تَابَ تَابَ اللَّهُ عَلَيْهِ أَلاَ لاَ تَؤُمَّنَّ امْرَأَةٌ رَجُلاً وَلاَ يَؤُمَّنَّ أَعْرَابِيٌّ مُهَاجِرًا وَلاَ يَؤُمَّ فَاجِرٌ مُؤْمِنًا إِلاَّ أَنْ يَقْهَرَهُ بِسُلْطَانٍ يَخَافُ سَيْفَهُ وَسَوْطَهُ) হযরত জাবির ইবনু আবদুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি বলেনঃ হে মানবমন্ডলী! তোমরা মরার পূর্বেই মহান আল্লাহ পাকের নিকট তওবা করো এবং কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ার পূর্বেই সৎ কাজের দিকে দ্রুত ধাবিত হও। তাঁর অধিক যিকরের মাধ্যমে তোমাদের রবের সাথে তোমাদের সম্পর্ক স্থাপন করো এবং গোপনে ও প্রকাশ্যে অধিক পরিমাণে দান-খয়রাত করো, এজন্য তোমাদের রিযিক বাড়িয়ে দেয়া হবে, সাহায্য করা হবে এবং তোমাদের অবস্থার সংশোধন করা হবে।

তোমরা জেনে রাখো, নিশ্চয় মহান আল্লাহ তাআলা আমার এই স্থানে আমার এই দিনে, আমার এই মাসে এবং আমার এই বছরে তোমাদের উপর কিয়ামতের দিন পর্যন্ত জুমু’আর নামাযকে ফরয করেছেন। অতএব যে ব্যক্তি আমার (মুবারক) জিন্দেগীতে বা আমার প্রস্থানের পরে, ন্যায়পরায়ণ অথবা যালেম শাসক থাকা সত্ত্বেও জুমু’আর নামাযকে তুচ্ছ মনে করে বা অস্বীকার করে তা বর্জন করবে, মহান আল্লাহ পাক তার বিক্ষিপ্ত বিষয়কে একত্রে গুছিয়ে দিবেন না (অর্থাৎ তার দুনিয়াবি জঞ্জালগুলি আরো জগাখিচুড়ী হয়ে যাবে) এবং তার কাজে-কর্মে বরকত দান করবেন না। নাউযুবিল্লাহ!

(অতএব) সাবধান! তার সালাত, যাকাত, হাজ্জ (হজ্জ), সাওম (রোযা) এবং অন্য কোন নেক আমল গ্রহণ করা হবে না, যতক্ষণ না সে তওবা করে। যে ব্যক্তি তওবা করে, মহান আল্লাহ তাআলা তার তওবা কবূল করেন। সাবধান! কোনো নারীকে পুরুষের ওপর ইমাম নিযুক্ত করবেনা, কোনো বেদুইনকে কোনো মুহাজিরের ওপর ইমাম নিযুক্ত করবেনা, কোনো খারাপ ব্যক্তিকে কোনো (সত্যিকার) মুমিনের ওপর ইমাম নিযুক্ত করবেনা। তবে কোন স্বৈরাচারী শাসক যদি বাধ্য করে এবং তার তরবারি ও চাবুকের ভয় থাকে তাহলে তা স্বতন্ত্র কথা। (ইবনে মাজাহ শরীফঃ ১০৮১)

মহান আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে পবিত্র জুমু’আহ শরীফ সহ দৈনিক ৫ ওয়াক্ত নামায জামায়াতে আদায়ের তৌফিক দিন, জামায়াতে না পারলেও অন্তত একা আদায়ের তৌফিক যেনো দেন, এই আর্জি পেশ করলাম মালিক মহান রব্বুল আলামিনের দরবারে। আল ফাতিহা (সূরাহ ফাতিহা দিয়ে দোয়া শেষ করবেন।)


সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুনঃ

এডমিন

আমার লিখা এবং প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা সম্পূর্ণ বে আইনি।

0 ফেইসবুক: