এমন কোন মানুষ নাই যার কোন প্রিয়জন নাই, বন্ধু-বান্ধব নাই, জীবনে একজন মানুষ হলেও তার সঙ্গি হিসেবে থাকবে যার কারণে সে সবকিছুই করতে পারে, যে তার ভালো খারাপের সঙ্গি হিসেবে বিদ্যমান থাকে সারাজীবন। মূলত মানুষের জীবনের বিরাট একটা অংশ জুড়ে বন্ধু বান্ধবের স্থান থাকে। একজন ভালো বন্ধু মানেই ভালো একটি পরিবেশ, ভালো একটি সময় পার করা, আবার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো নষ্ট করে যদি কারো অসৎ বন্ধু থাকে। অনেকের দ্বীনি পরিবেশ থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণ তাদের অসৎ চরিত্রের বন্ধুগুলোই হয়ে থাকে। আবার অনেকের জীবন পাল্টে দেয় কিছু ভালো বন্ধু, উত্তম চরিত্রের অধিকারী প্রিয়জন। যেহেতু বন্ধুত্বহীন হয়ে কেউ চলতে পারে না, সেহেতু কারো কারো ভালো বন্ধু থাকে আবার কারো থাকে খারাপ বন্ধু। তো স্বরনে রাখা উচিৎ যে, এই বন্ধু মানুষের জীবনকে কঠিনভাবে প্রভাবিত করে। তাই কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধু ভাবার আগে যদি ব্যক্তি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে সে বন্ধুই তাকে মন্দের দিকে নিয়ে যায়। তাকে দ্বীনি পরিবেশ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। মহান আল্লাহ তা’আলার নাফারমানিতে লিপ্ত হওয়ার পথ সহজ করে দেয়। রসূলে পাঁক ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের মাক্কী যুগে উবাই ইবনু খলফ ও উকবা ইবনু আবি মুআইত ছিল একে অপরের অন্তরঙ্গ বন্ধু। একদিন উকবা রসূলে পাঁক ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের মজলিশে এসে দ্বীনি আলোচনা শুনলো। সেটা জেনে গিয়েছিলে তার বন্ধু ইসলামের শত্রু উবাই ইবনু খলফ। তখন উবাই উকবার কাছে এসে তাকে জিজ্ঞেস করলো তুমি নাকি মুহম্মদ (ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের) সাথে উঠাবসা শুরু করেছো? উনার কথা শুনছো? আমি আর তোমার সাথে কথা বলব না, আমাদের বন্ধুত্ব আজ থেকে শেষ, এরপর উবাই শপথ করে বললো, তুমি যদি আর মুহম্মদ (ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের) কাছে যাও তাহলে তোমার চেহারাও আমি আর দেখব না, আর যদি চাও আমাদের বন্ধুত্ব টিকে থাকুক তাহলে তোমাকে মুহম্মদ (ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের) মুখে থুথু মেরে আসতে হবে! (নাউজুবিল্লাহ) অভিশপ্ত লানতুল্লাহ উকবা তখন বন্ধুত্বের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে দিশেহারা হয়ে রসুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের মুখে থুথু নিক্ষেপ করতে বেরিয়ে পড়লো (নাউজুবিল্লাহ); বন্ধুত্বের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে মহান আল্লাহ তা’আলার দ্বীন ও রসুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের গোস্তাখী ও অবাধ্যতায় লিপ্ত হলো, আর মহান আল্লাহ তা’আলার প্রেরিত হিদায়াত থেকে ছিটকে পড়লো। (সিরাত ইবনে হিশাম)
এর থেকেই বুঝা যায় যে, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো বেশির ভাগ বন্ধুর কাছ থেকেই এসে থাকে। যদি বন্ধু খোদাদ্রোহী হয় চরিত্রহীন হয় লম্পট হয় তাহলে তার সিদ্ধান্ত কেমন হবে ব্যক্তি তা খুব ভালো করেই জানে। কিয়ামতের কঠিন দিনে খারাপ বন্ধুর পাল্লায় থাকা অসংখ্য মানুষ সেদিন আফসোস করবে, যার ব্যপারে নসিহত পাওয়া যায় আল কুরআনে এইভাবে, (وَ یَوۡمَ یَعَضُّ الظَّالِمُ عَلٰی یَدَیۡهِ یَقُوۡلُ یٰلَیۡتَنِی اتَّخَذۡتُ مَعَ الرَّسُوۡلِ سَبِیۡلًا یٰوَیۡلَتٰی لَیۡتَنِیۡ لَمۡ اَتَّخِذۡ فُلَانًا خَلِیۡلًا) সেদিন যালেম ব্যক্তি (ক্ষোভে দুঃখে) নিজের দুটো হাত দংশন করতে করতে বলবে, হায়! আমি যদি দুনিয়ায় রসূলে পাঁক ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের সাথে (দ্বীনের) পথ অবলম্বন করতাম! দুর্ভাগ্য আমার, আমি যদি অমুক লোকটিকে আমার বন্ধু না বানাতাম! (সূরাহ ফুরকান ২৫/২৭-২৮)
অর্থাৎ যারাই রসূলে পাঁক ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের প্রদর্শিত পথে না চলে অন্য কারো নির্দেশিত পথে চলবে, তারাই হাশরের মাঠে আফসোস করতে থাকবে এবং নিজের আঙ্গুল কামড়াতে থাকবে। কিন্তু তখন তাদের সে আফসোস তাদের কোন উপকারেই আসবে না। উক্ত আয়াত শরীফের ভাষা যেমন ব্যাপক, তার বিধানও তেমনি ব্যাপক। এই ব্যাপকতার দিকে ইঙ্গিত করার জন্যই সম্ভবতঃ মহান আল্লাহ তাআলা আয়াতে পাঁকে বন্ধুর নামের পরিবর্তে فلانا বা “অমুক” শব্দ ব্যবহার করেছেন। আয়াতে বিধৃত হয়েছে যে, যে দুই বন্ধু সম্মিলিতভাবে পাপ কাজে জড়িত হয় এবং শরীয়ত বিরোধী কার্যাবলীতে একে অপরের সাহায্য করে, তাদের সবারই বিধান এই যে, কেয়ামতের দিন তারা এই বন্ধুত্বের কারণে কান্নাকাটি করবে, আঙ্গুল কামড়াবে। এছাড়াও রসূলে পাঁক ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “কোন অমুসলিমকে সঙ্গী বানিও না এবং তোমার ধনসম্পদ (সঙ্গীদের দিক দিয়ে) যেন মুক্তাকীরাই খায়।” (মুসনাদে আহমাদ ৩/৩৮, সহীহ ইবনে হিব্বানঃ ২/৩১৫, হাদীস নং ৫৫৫, তিরমিযী শরীফ ২৩৯৫, আবু দাউদ শরীফ ৪৮৩২) অর্থাৎ মুত্তাকী বা পরহেযগার নয় এমন কোন ব্যক্তিকে জীবন চলার পথের প্রিয়জন সঙ্গি বানিও না, বন্ধু বানিও না, নাহলে তারা তোমার মাল সম্পদ খাবে অথচ তা মহান আল্লাহ তাআলার নিকট অপছন্দনিয়। রসূলে পাঁক ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেনঃ “প্রত্যেক মানুষ (অভ্যাসগতভাবে) বন্ধুর ধর্ম ও চালচলন অবলম্বন করে। তাই কিরূপ লোককে বন্ধুরূপে গ্ৰহণ করা হচ্ছে, তা পূর্বেই ভেবে দেখা উচিত।” (আবু দাউদ শরীফ ৪৮৩৩, তিরমিযী শরীফ ২৩৭৮, মুসনাদে আহমাদঃ ২/৩৩৪)
অতএব উক্ত আয়াত শরীফ ও হাদিসে পাঁক থেকে জানা গেলো যে, যারা মহান আল্লাহ তা’আলার অবাধ্য লোক, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব রাখা ঠিক নয়। কারণ, মানুষ সৎ সঙ্গে ভালো ও অসৎ সঙ্গে খারাপ হয়ে যায়। বেশির ভাগ লোকদের পথভ্রষ্ট হওয়ার কারণ অসৎ বন্ধু ও খারাপ সঙ্গীদের সাথে উঠা বসা। আর একারণেই হাদীস শরীফে সৎ সঙ্গী গ্রহণ এবং অসৎ সঙ্গী বর্জন করার ব্যাপারকে (আতর-ওয়ালা ও কামারের সাথে) উদাহরণ দিয়ে স্পষ্ট করা হয়েছে। সৎ সঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর উদাহরন মেশক বিক্রেতা ও কর্মকারের হাপরের ন্যায়। আতর বিক্রেতার থেকে তুমি রেহাই পাবেনা। হয় তুমি আতর খরিদ করবে, না হয় তার সুঘ্রান পাবে। আর কর্মকারের হাপর হয় তোমার দেহ অথবা কাপড় পুড়িয়ে দেবে, না হয় আপনি তার দ্বারা দুর্গন্ধময় হবেন। (বুখারি শরীফ ২১১০, মুসলিম শরীফ ২৬২৮)
অতএব কার সাথে কেমন কথা বলেছেন, কোথায় সময় নষ্ট করেছেন, অসৎ বন্ধুর সাথে নীরবে নিভৃতে কোথায় গিয়েছেন, পার্কে গিয়ে কার সাথে দেখা করেছেন, রাতের অন্ধকারে অসৎ কোন বন্ধুর সাথে কখন কোথায় নেশায় লিপ্ত হয়েছেন, কোন গার্লফ্রেন্ডের সাথে কেমন চ্যাটিং করেছেন। প্রতিটি কাজের হিসাব কিয়ামতের দিন নেয়া হবে। কারো সাথেই বিন্দু পরিমাণ বেইনসাফি করা হবে না। কোনো দলীয় আধিপত্য থাকবে না, স্বজনপ্রীতি থাকবে না। এমন কঠিন পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেনঃ (وَ وُضِعَ الۡکِتٰبُ فَتَرَی الۡمُجۡرِمِیۡنَ مُشۡفِقِیۡنَ مِمَّا فِیۡہِ وَ یَقُوۡلُوۡنَ یٰوَیۡلَتَنَا مَالِ ہٰذَا الۡکِتٰبِ لَا یُغَادِرُ صَغِیۡرَۃً وَّ لَا کَبِیۡرَۃً اِلَّاۤ اَحۡصٰہَا ۚ وَ وَجَدُوۡا مَا عَمِلُوۡا حَاضِرًا ؕ وَ لَا یَظۡلِمُ رَبُّکَ اَحَدًا) (অতঃপর তাদের সামনে) আমলনামা রাখা হবে, (তখন) নাফরমান ব্যক্তিদের আপনি দেখবেন, সেই আমলনামায় যা কিছু লিপিবদ্ধ আছে এর কারণে তারা (খুবই) আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়বে, তারা বলতে থাকবে, হায় দুর্ভাগ্য আমাদের, এ (আবার) কেমন গ্রন্থ! এ তো (দেখছি আমাদের জীবনের) ছোটো কিংবা বড়ো প্রত্যেক বিষয়েরই হিসাব রেখেছে, তারা যা কিছু করেছে তার প্রতিটি বস্তুই তারা (সে গ্রন্থে) মজুদ দেখতে পাবে, আপনার মালিক (সেদিন) কারো ওপর বিন্দুমাত্র জুলুম করবেন না। (সূরা কাহ্ফ ১৮/৪৯) বিচারদিনে এমন পরিস্থিতি দেখে তখন বান্দা আফসোস করতে থাকবে। আর বলবে যদি আমাদের আবার সুযোগ দেয়া হতো আমরা ভালো হয়ে যেতাম। সেদিন তাদের অসৎ বন্ধুগুলো তাদের কোনো কাজেই আসবে না। প্রত্যেকে নিজের কৃতকর্মের জন্য চিন্তিত থাকবে। নিজের মন্দ কর্মের ফলাফল প্রত্যক্ষ করে বলবে যদি আমাদের আবার সুযোগ দিতো! আমরা ভালো হয়ে যেতে পারতাম। অসৎ বন্ধুদের পরিত্যাগ করে একেবারে দ্বীনের জন্য সময় ব্যয় করতাম! তাদের এ আফসোসের কথা মহান আল্লাহ তা’আলা আল কুরআনে উল্লেখ করেছেন এইভাবেঃ (وَ لَوۡ تَرٰۤی اِذۡ وُقِفُوۡا عَلَی النَّارِ فَقَالُوۡا یٰلَیۡتَنَا نُرَدُّ وَ لَا نُکَذِّبَ بِاٰیٰتِ رَبِّنَا وَ نَکُوۡنَ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ) “আপনি যদি দেখতে পেতেন (তাহলে সত্যিই আপনি এমন এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখতেন) যখন এই (হতভাগ্য) ব্যক্তিদের (দোযখের মধ্যে থাকা জ্বলন্ত) আগুনের পাশে এনে দাঁড় করানো হবে, তখন তারা (চিৎকার করে) বলবে, হায়! যদি আমাদের আবার (দুনিয়ায়) ফেরত পাঠানো হতো, তাহলে আমরা (আর কখনো) আমাদের মালিকের আয়াত সমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতাম না এবং আমরা (অবশ্যই) ঈমানদার লোকদের দলে শামিল হয়ে যেতাম। (সূরা আনআম ৬/২৭)। ভাই ও বোনেরা একটু ভয় করুণ, চোখ বুঝে দেখুন বন্ধুর দলে কারা কারা আছে যাদের আজকে পরিত্যাগ করতে আপনার কষ্ট হচ্ছে অথচ এই কারণে একদিন আফসোস করবেন কিন্তু পরিত্যাগের সুযোগ থাকবেনা। অতঃপর যখন যে যার প্রাপ্য বুঝে পাবে তখন মুমিনরা জান্নাতের দিকে অগ্রসর হবে। মুনাফিক ও কাফেরা বলবে আমাদের জন্য একটু অপেক্ষা করো, আমরাও তোমাদের সাথে দুনিয়ায় ছিলাম। তোমার সাথে থাকতাম, বাজারে যেতাম, কলেজে পড়তাম, বিয়েতে যেতাম। আজ তোমরা আমাদের রেখে চলে যাচ্ছো?
পবিত্র আল কুরআনের তাদের বক্তব্যটি এভাবে উল্লেখ করেছেন মহান আল্লাহ পাকঃ (یَوۡمَ یَقُوۡلُ الۡمُنٰفِقُوۡنَ وَ الۡمُنٰفِقٰتُ لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوا انۡظُرُوۡنَا نَقۡتَبِسۡ مِنۡ نُّوۡرِکُمۡ ۚ قِیۡلَ ارۡجِعُوۡا وَرَآءَکُمۡ فَالۡتَمِسُوۡا نُوۡرًا ؕ فَضُرِبَ بَیۡنَہُمۡ بِسُوۡرٍ لَّہٗ بَابٌ ؕ بَاطِنُہٗ فِیۡہِ الرَّحۡمَۃُ وَ ظَاہِرُہٗ مِنۡ قِبَلِہِ الۡعَذَابُ یُنَادُوۡنَہُمۡ اَلَمۡ نَکُنۡ مَّعَکُمۡ ؕ قَالُوۡا بَلٰی وَ لٰکِنَّکُمۡ فَتَنۡتُمۡ اَنۡفُسَکُمۡ وَ تَرَبَّصۡتُمۡ وَ ارۡتَبۡتُمۡ وَ غَرَّتۡکُمُ الۡاَمَانِیُّ حَتّٰی جَآءَ اَمۡرُ اللّٰہِ وَ غَرَّکُمۡ بِاللّٰہِ الۡغَرُوۡرُ) “সেদিন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারীরা ঈমানদারদের বলবে, তোমরা আমাদের দিকে একটু তাকাও, যাতে করে আমরা তোমাদের নূর থেকে কিছুটা হলেও আলো গ্রহণ করতে পারি, তাদের বলা হবে, তোমরা (আজ) পেছনে ফিরে যাও এবং (পারলে সেখানে গিয়ে) আলোর সন্ধান করো; অতঃপর এদের (উভয়ের) মাঝখানে একটি প্রাচীর দাঁড় করিয়ে দেয়া হবে, এতে একটি দরজাও থাকবে; যার ভেতরের দিকে থাকবে (মহান আল্লাহ তা’আলার) রহমত, আর তার বাইরের দিকে থাকবে (ভয়াবহ) আজাব। তখন মুনাফিক দল ঈমানদারদের ডেকে বলবে, আমরা কি (দুনিয়ার জীবনে) তোমাদের সাথী ছিলাম না; তারা বলবে, হ্যাঁ (অবশ্যই ছিলে), তবে তোমরা নিজেরাই নিজেদের (গোমরাহির বিপদে) বিপদগ্রস্ত করে দিয়েছিলে, তোমরা (সব সময় সুযোগের) অপেক্ষায় থাকতে, নানা রকমের) সন্দেহ পোষণ করতে (আসলে দুনিয়ার) মোহ তোমাদের সব সময়ই প্রতারিত করে রেখেছিলো, আর এভাবে (একদিন তোমাদের ব্যাপারে) মহান আল্লাহ তা’আলার (পক্ষ থেকে মৃত্যুর) ফায়সালা এসে হাযির হলো এবং সে (প্রতারক শয়তান) তোমাদের মহান আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কেও ধোঁকায় ফেলে রেখেছিলো।” (সূরা হাদিদ ৫৭/১৩-১৪) তখন মুনাফিক ও অস্বীকারকারীরা দিশেহারা হয়ে বলবে হায় আমি যদি আজ মাটি হয়ে যেতাম! মহান আল্লাহ তা’আলা তাদের এমন আকুতিটুকুও বাদ রাখেনি উনার কালামুল্লাহ শরীফ সুবহানআল্লাহ!, মহান আল্লাহ পাঁক বলেনঃ (اِنَّاۤ اَنۡذَرۡنٰکُمۡ عَذَابًا قَرِیۡبًا ۬ۚۖ یَّوۡمَ یَنۡظُرُ الۡمَرۡءُ مَا قَدَّمَتۡ یَدٰہُ وَ یَقُوۡلُ الۡکٰفِرُ یٰلَیۡتَنِیۡ کُنۡتُ تُرٰبًا) “আমি আসন্ন আজাব সম্পর্কে তোমাদের সতর্ক করে দিলাম, সেদিন মানুষ দেখতে পাবে তার হাত দু’টি এ দিনের জন্য কী কী জিনিস পাঠিয়েছে, (এ দিনকে) অস্বীকারকারী ব্যক্তি তখন বলে উঠবে (ধিক্ এমনি এক জীবনের জন্য), হায়, কতো ভালোই না হতো, যদি মানুষ (না হয়ে) আমি (আজ) মাটি হতাম!” (সূরা নাবা ৭৮/৪০) অতএব দুনিয়াতে যেসকল আপন মানুষ, প্রাণের দোস্ত, সঙ্গী যাদের সাথে না মিশলে সময় পার হতো না, যাদের সাথে সময় দিতে গিয়ে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ভুলে গেলেন, যাদের দ্বারা খারাপের দিকে আসক্ত হয়েছেন, যাদের চরিত্রে প্রভাবিত হয়ে মহান আল্লাহ তা’আলার অবাধ্য হয়েছেন আজ তারা কেউ আপনার ঐ সময়ের আমলের ভাগ নিতে আসবে না। সেদিন প্রত্যেকে তার কর্মফল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে, আর মহান আল্লাহ তা’আলার নিকট জবাবদিহিতার ভয়ে শঙ্কিত হবে।
এছাড়াও দুনিয়াবি সুখ সাফল্য লাভের জন্য যত বন্ধু আপনার ছিলো সবাই আপনার পর হয়ে যাবে সেদিন। কেবল পরই হবে না তারা, বরং শত্রুতেও পরিণত হবে। এখন জীবনে চলার পথে আমাদের কেমন বন্ধু প্রয়োজন তা বুঝতে হবে, কারণ কিয়ামতের দিন কেবল তাদেরই আপনি হাক্বিকতে উপকারি বন্ধু হিসেবে পাবেন যাদেরকে মহান আল্লাহ তা’আলা উনার জন্যই ভালোবেসেছেন। তারাই হবে আপনার জান্নাতের সঙ্গী যদি আপনি সে জান্নাত উপযোগী মানুষ হয়ে মহান আল্লাহ তা’আলার আদালতে আসার সৌভাগ্য অর্জনের জন্য দুনিয়াতে কাজ করেন। সেদিন একমাত্র মুত্তাকিরাই আপনার বন্ধু হবে। মানুষ বলে অসৎ বন্ধু থাকলে আর শত্রু লাগে না। আবার ভালো মানুষের সহবত পেলে কুকুরও ধন্য হয়। তার প্রমাণ আমরা দেখতে পাই আসহাবে কাহাফের ঘটনায়। এখানে আমি সূরা কাহাফের ব্যখায় যাব না। আপনারা বিস্তারিত জানতে চাইলে তাফসীরে গিয়ে পড়ে নিতে পারেন। আসহাবে কাহাফের অধিবাসীরা অত্যাচারী রাজার কাছ থেকে ঈমান বাঁচাতে যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা মহান আল্লাহ তাআলা সমগ্র উম্মাহর জন্য শিক্ষণীয় হিসেবে আল কুরআনে কিয়মত পর্যন্ত ইবরতের জন্যে রেখে দিলেন।
বন্ধু নির্বাচনে তিনটি গুণকে প্রাধান্য দিতে হবেঃ
১) খোদাভীরু।
২) আমানতদারি।
৩) সত্যবাদী।
মহান আল্লাহ তা;আলা তায়ালা বলেছেনঃ (اَلۡاَخِلَّآءُ یَوۡمَئِذٍۭ بَعۡضُہُمۡ لِبَعۡضٍ عَدُوٌّ اِلَّا الۡمُتَّقِیۡنَ) “যখন সে দিনটি আসবে তখন মুত্তাকিরা ছাড়া অবশিষ্ট সব বন্ধুই একে অপরের দুশমন হয়ে যাবে।” (সূরা যুখরুফ ৪৩/৬৭) কেননা, কাফেরদের বন্ধুত্ব কেবল কুফরী ও পাপাচারের ভিত্তিতে হয় এবং এই কুফরী ও পাপাচারই তাদের আযাবের কারণ হবে। আর এরই কারণে তারা একে অপরকে দোষারোপ করবে এবং পরস্পরের শত্রু হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে ঈমানদার ও আল্লাহভীরু লোকদের পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও ভালবাসা যেহেতু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের ভিত্তিতে হয়, আর এই দ্বীন ও ঈমানই হল কল্যাণ ও সওয়াব লাভের মাধ্যম, সেহেতু তাঁদের এই বন্ধুত্বে কোন বিচ্ছেদ ঘটবে না। আখেরাতেও তাঁদের এই বন্ধুত্ব অটুট থাকবে, যেমন দুনিয়াতে ছিল। তাই আমাদের বন্ধুত্ব তৈরির ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে তার কর্ম, আচার ব্যবহার, কথা-বার্তা, চিন্তা-চেতনা, স্বভাব-চরিত্র ইত্যাদির। কারণ একজন বন্ধু সহজে যেকোনো দিকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবনে অসৎ খোদাদ্রোহী বন্ধু থেকে হেফাজত করুন। এমন বন্ধু আমাদের দান করুন যাদের নিয়ে জান্নাতেও একসাথে থাকতে পারি। এমন বন্ধু আল্লাহ আমাদের দান করুন যারা আমাদের জান্নাতের পথে আহবান করে।
অতএব শুধু দোয়া চেয়ে ক্ষ্যান্ত হলেই হবেনা, বরং কোন মানুষকে বন্ধু হিসেবে নির্বাচন করতে হলে যে গুণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে তা বর্ণনা করতে গিয়ে মহান আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ کُوۡنُوۡا مَعَ الصّٰدِقِیۡنَ ) হে মুমিনগণ, তোমরা মহান আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও।’ (৯/১১৯) পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে জিহাদ থেকে বিরত থাকায় যে ত্রুটি কতিপয় নিষ্ঠাবান সাহাবীদের দ্বারাও হয়ে গেল এবং পরে তাঁদের তাওবাও কবুল হলো, এ ছিল তাঁদের তাকওয়ারই ফলশ্রুতি। তাই এ আয়াতের মাধ্যমে সমস্ত মুসলিমকে তাকওয়া অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর “তোমরা সবাই সত্যবাদীদের সাথে থাক” বাক্যে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, সত্যবাদীদের সাহচর্য এবং তাদের অনুরূপ আমলের মাধ্যমেই তাকওয়া লাভ হয়। আর এভাবেই কেউ ধ্বংস থেকে মুক্তি পেতে পারে। প্রতিটি বিপদ থেকে উদ্ধার হতে পারে। (ইবন কাসীর)
এতো গেলো মুসলিম নামধারীদের ব্যপারে মহান আল্লাহ তাআলার নির্দেশনা, অথচ কেবল বাহিরের মানুষ না, খোদ ঘরের মানুষদের ব্যপারেও মহান আল্লাহ তা’আলা হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন এইভাবেঃ (یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَتَّخِذُوۡۤا اٰبَآءَکُمۡ وَ اِخۡوَانَکُمۡ اَوۡلِیَآءَ اِنِ اسۡتَحَبُّوا الۡکُفۡرَ عَلَی الۡاِیۡمَانِ ؕ وَ مَنۡ یَّتَوَلَّهُمۡ مِّنۡکُمۡ فَاُولٰٓئِکَ هُمُ الظّٰلِمُوۡنَ) হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজদের পিতা (মাতাও এর অন্তর্ভুক্ত) ও ভাইদেরকেও (বোনেরাও অন্তর্ভুক্ত) বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরীকে প্রিয় মনে করে। তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারাই যালিম। (সূরাহ তাওবা ৯/২৩)
চিন্তা করা যায়? সহপাঠি, ক্লাসমিট, কলিগ এর ব্যপারে নয়, খোদ বাপ ভাইয়ের ব্যপারেও মহান আল্লাহ তা’আলার নির্দেশনা কেমন দেখুন। এখানে আল্লাহ তা'আলা সেইসব মানুষদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে মুমিনদেরকে নিষেধ করছেন যারা খোদাদ্রোহী, যদিও তারা তোমাদের মাতা, পিতা, ভাই, বোন প্রভৃতি হাক না কেন, যদি তারা ইসলামের উপর কুফরীকে পছন্দ করে নেয়, প্রাধান্য দেয় তাহলে তাদের প্রতি কোন মুহব্বত রাখা যাবেনা, তাদেরকে বন্ধু, অবিভাবক হিসেবে গ্রহণ করা যাবেনা।
উক্ত আয়াত মূলত জ্বিহাদ ও হিজরতের কারনেই নাযিল হয়েছিল, সেক্ষেত্রে দ্বীনের উদ্যেশ্যে যদি জ্বিহাদ বা হিজরতের প্রয়োজন হয় তাহলে দেশ, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও অর্থ-সম্পদকে বিদায় জানাতে হবে। আর এটি হল মনুষ্য স্বভাবের পক্ষে বড় কঠিন কাজ। তাই এ আয়াতে এদের সাথে মাত্রাতিরিক্ত ভালবাসার নিন্দা করে হিজরত ও জিহাদের জন্য মুসলিমদের উৎসাহিত করা হয় এই বলে যে “হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদের পিতা ও ভাইদের অলীরূপে গ্রহণ করো না যদি তারা ঈমানের বদলে কুফরকে ভালবাসে। আর তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে অলীরূপে গ্রহণ করে, তারাই হবে সীমালংঘনকারী।” মাতা-পিতা, ভাই-বোন এবং অপরাপর আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার তাগিদ দিয়ে কুরআনের বহু আয়াত নাযিল হয়েছে। কিন্তু আলোচ্য আয়াতে বলা হয় যে, প্রত্যেক সম্পর্কের একেকটি সীমা আছে এবং এ সকল সম্পর্ক তা মাতা-পিতা, ভাইবোন ও আত্মীয়-স্বজন যার বেলাতেই হোক, মহান আল্লাহ তা’আলা ও উনার রসূল ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের বিপরীতে গেলে তাদের সাথেও সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে।
যেখানেই এ দু’সম্পর্কের সংঘাত দেখা দেবে, সেখানেই মহান আল্লাহ তা’আলা ও উনার রসূল ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের সম্পর্ককেই বহাল রাখা ফরজ। মহান আল্লাহ তা’আলা আত্মীয়তার সম্পর্ক কতক্ষণ পর্যন্ত ঠিক রাখা যাবে আর কখন রাখা যাবে না তা নির্ধারণ করেই দিয়েছেন। ইমাম বায়হাকী রহমতুল্লাহি স্বীয় হাদীস গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, বদরের যুদ্ধের দিন আবু উবাইদাহ্ ইবনে জাররাহ রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর পিতা উনার সম্মুখে এসে মূর্তির প্রশংসা করতে শুরু করে দেন। তিনি তাকে বারবার বিরত রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার কুফরি বেড়েই চলছিলো, তখন পিতা-পুত্রের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আবু উবাইদাহ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় পিতাকে হত্যা করে দেন। তখন আল্লাহ তা’আলা আয়াত নাযিল করে জানিয়ে দেনঃ (لَا تَجِدُ قَوۡمًا یُّؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ یُوَآدُّوۡنَ مَنۡ حَآدَّ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ وَ لَوۡ کَانُوۡۤا اٰبَآءَهُمۡ اَوۡ اَبۡنَآءَهُمۡ اَوۡ اِخۡوَانَهُمۡ اَوۡ عَشِیۡرَتَهُمۡ ؕ اُولٰٓئِکَ کَتَبَ فِیۡ قُلُوۡبِهِمُ الۡاِیۡمَانَ وَ اَیَّدَهُمۡ بِرُوۡحٍ مِّنۡهُ ؕ وَ یُدۡخِلُهُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِهَا الۡاَنۡهٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡهَا ؕ رَضِیَ اللّٰهُ عَنۡهُمۡ وَ رَضُوۡا عَنۡهُ ؕ اُولٰٓئِکَ حِزۡبُ اللّٰهِ ؕ اَلَاۤ اِنَّ حِزۡبَ اللّٰهِ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ) মহান আল্লাহ তা’আলা ও আখেরাতে ঈমান রাখে এমন কোন সম্প্রদায়কে আপনি পাবেন না, যারা মহান আল্লাহ তা’আলা ও উনার রসূল ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতাকারীদেরকে ভালবাসে, যদিও তারা তাদের পিতা(মাতা), অথবা পুত্র(মেয়ে), অথবা ভাই(বোন), অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয়। এরাই (তারা), যাদের অন্তরে মহান আল্লাহ তাআলা ঈমানকে বদ্ধমূল করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন উনার অদৃশ্য (রূহের) শক্তি দ্বারা; তাদেরকে তিনি দাখিল করবেন এমন সব জান্নাতসমূহে যার নিচে দিয়ে ঝর্ণাধারাসমূহ প্রবাহিত হয়। তাতে তারা চিরকাল থাকবে। (আর) মহান আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট আর তারাও উনার প্রতি সন্তুষ্ট। এরাই মহান আল্লাহ তা’আলার দল। জেনে রাখ, নিশ্চয় মহান আল্লাহ তা’আলার দলই সফলকাম হবে। (মুজাদালাহ ৫৮/২২)
অতএব উক্ত আয়াত শরিফদ্বয় ও হাদিসের ঘটনা থেকে প্রমাণ হয়ে গেলো যে, মুহব্বতের মাপকাঠি, বন্ধুত্বের মাপকাঠি হলেন মহান আল্লাহ তা’আলা ও রসূলে পাঁক ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলাইহি ওয়া সাল্লাম, এবং উনাদের মুহব্বতকেই সবকিছুর উপর স্থান দিতে হবে। উনাদের কারনেই বন্ধুত্ব করতে হবে শত্রুতাও সৃষ্টি হবে উনাদের মুহব্বতে। মহান আল্লাহ তা’আলা স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেনঃ (یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَتَّخِذُوا الۡکٰفِرِیۡنَ اَوۡلِیَآءَ مِنۡ دُوۡنِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَؕ اَتُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ تَجۡعَلُوۡا لِلّٰهِ عَلَیۡکُمۡ سُلۡطٰنًا مُّبِیۡنًا) হে মুমিনগণ, তোমরা মুমিনগণ ছাড়া কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা কি মহান আল্লাহ তা’আলাকে তোমাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রমাণ (দিয়ে) দিতে চাও? (৪/১৪৪) অর্থাৎ, মহান আল্লাহ তা’আলা মুমিন ব্যতীত কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন। এখন যদি তোমরা তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন কর, তাহলে তার অর্থ হবে তোমরা নিজেদের বিরুদ্ধে মহান আল্লাহ তাআলাকে প্রমান দিয়ে দিচ্ছ তোমাদের অপরাধের; যাতে করে তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দিতে পারেন। (অর্থাৎ, মহান আল্লাহ তা’আলার অবাধ্যতা এবং উনার নির্দেশ অমান্য করার কারণে তিনি যেনো তোমাদেরকে শাস্তি দেন।) তাই মুমিন ব্যতীত কোন অমুসলিমের সাথে বন্ধুত্ব কোন অবস্থায় করাই যাবেনা। অথচ আমরা যদি আজকে আমাদের আশেপাশে তাকাই তাহলে দেখবো যে, যেখানে জন্মদাতা মা বাপ, ভাই বোনের ব্যপারে মহান আল্লাহ পাঁক কঠোর অবস্থান নিয়েছেন যদি তারা দ্বীনদার না হয়, সেখানে মানুষ কাফের মুশরিকদের ও আজকাল বন্ধু বানায়, মুহব্বত করে, ভালোবাসে, অথচ মহান আল্লাহ পাঁক হুঁশিয়ার করে দিচ্ছেন এইভাবে যেঃ ( یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَتَّخِذُوا الۡیَهُوۡدَ وَ النَّصٰرٰۤی اَوۡلِیَآءَ ۘؔ بَعۡضُهُمۡ اَوۡلِیَآءُ بَعۡضٍ ؕ وَ مَنۡ یَّتَوَلَّهُمۡ مِّنۡکُمۡ فَاِنَّهٗ مِنۡهُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یَهۡدِی الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ) হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইহুদী ও নাসারাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না, (কারণ) তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে কেউ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তা’আলা যালিম সম্প্রদায়কে হেদায়েত দান করেন না। (সূরাহ মায়েদা ৫/৫১) পূর্বে মুশরিকদের সাথে বন্ধুত্ব নিষিদ্ধ হওয়ার পরে, কিতাবের অধিকারী ইহুদী ও খ্রিষ্টানদেরকেও বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা তারা মহান আল্লাহ তা’আলাকে স্বীকার করে থাকলেও রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম, দ্বীন ইসলাম ও মুসলমানের শত্রু। তাই যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখবে তাদের জন্য কঠিন শাস্তির কথাও ঘোষণা করা হয়েছে এইভাবে যে, তারা তদেরই দলভুক্ত বলে গণ্য হবে। শুধু তাই নয়, মহান আল্লাহ পাঁক আরো কঠিন রূপে অবতীর্ণ হয়ে বলেনঃ (لَا یَتَّخِذِ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ الۡکٰفِرِیۡنَ اَوۡلِیَآءَ مِنۡ دُوۡنِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ۚ وَ مَنۡ یَّفۡعَلۡ ذٰلِکَ فَلَیۡسَ مِنَ اللّٰهِ فِیۡ شَیۡءٍ اِلَّاۤ اَنۡ تَتَّقُوۡا مِنۡهُمۡ تُقٰىۃً ؕ وَ یُحَذِّرُکُمُ اللّٰهُ نَفۡسَهٗ ؕ وَ اِلَی اللّٰهِ الۡمَصِیۡرُ) মু’মিনগণ যেন মু’মিনগণ ছাড়া কাফিরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব না করে, মূলতঃ যে এমন করবে মহান আল্লাহ তা’আলার সাথে তার কোন (ধরণের) সম্পর্ক নেই, তবে ব্যতিক্রম হল যদি তোমরা তাদের যুলম হতে আত্মরক্ষার জন্য সতর্কতা অবলম্বন কর। এবং মহান আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে উনার নিজের পবিত্র অস্তিত্বের ভয় প্রদর্শন করছেন আর মহান আল্লাহ তা’আলার দিকে (তোমাদের) ফিরে যেতে হবে। (৩/২৮) চিন্তা করা যায়? কি কঠিন বিষয়, মহান আল্লাহ তা'আলা মুমিনদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তারা যেন মুমিনদের ছেঁড়ে কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব ও ভালবাসা স্থাপন না করে বরং তারা যেনো তাদের পরস্পরের মধ্যে মুহব্বত ও ভালোবাসা রাখে। অতঃপর তিনি সতর্ক করে বলছেন, যে ব্যক্তি এরূপ করবে অর্থাৎ অমুসলিম কাফেরদের সাথে যারা বন্ধুত্ব স্থাপন করবে তার প্রতি তিনি রাগান্বিত হয়ে যাবেন। যার ফলে মহান আল্লাহ তা’আলার সাথে তার আর কোন সম্পরকই থাকবেনা নাউযুবিল্লাহ!!! কার বুকের পাটা এমন যে সে চায় মহান আল্লাহ পাঁকের সাথে তার সকল সম্পর্ক শেষ হয়ে যাক? কোন মুমিনের পক্ষে ইহা কস্মিনকালেও সম্ভব না। তবে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটি ঐ সময়ই হবে, যখন ব্যক্তির সেখানে ইচ্ছা বা এখতিয়ার থাকবে। কিন্তু যখন ভয়-ভীতি বা সমস্যা থাকবে, তখন তাদের সাথে বাহ্যিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কস্থাপনের অনুমতি ইসলাম শর্তসাপেক্ষে দিয়েছেণ। তা হচ্ছে, যতটুকু করলে তাদের ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রেও আন্তরিক বন্ধুত্ব থাকতে পারবে না। অর্থাৎ কোন মুসলিম কোন অমুসলিম এলাকায় বসবাস করে, সেখানে তাঁকে তাদের সাথে বাধ্যতামূলক চলাফেরা উঠাবসা করতে হয়, তখন সেই বিষয়টা দোষের হবেনা যদি না সে তাঁর অন্তরে তাদের প্রতি কোন মুহব্বত রাখে।
কিন্তু আজকের দুনিয়ায় যদি ধনী মুসলিমদের দিকে আমরা তাকাই তাহলে আমরা দেখতে পাই, মজবুরি নাই তার পরেও তারা কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করে থাকে কেবল এই আশায় যে তারা সমাজে সম্মানিত হবে, কিন্তু তাদের এই ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে মহান আল্লাহ তা’আলা বাতিল করে দিয়ে বলেনঃ (الَّذِیۡنَ یَتَّخِذُوۡنَ الۡکٰفِرِیۡنَ اَوۡلِیَآءَ مِنۡ دُوۡنِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ؕ اَیَبۡتَغُوۡنَ عِنۡدَهُمُ الۡعِزَّۃَ فَاِنَّ الۡعِزَّۃَ لِلّٰهِ جَمِیۡعًا) মুমিনগণের পরিবর্তে যারা কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারা কি ওদের কাছে ইযযত-সম্মান চায়? অথচ সমস্ত সম্মানই তো মহান আল্লাহ তা’আলার। (নিসা ৪/১৩৯) পবিত্র এ আয়াতে পাঁকে কাফের ও মুশরিকদের সাথে আন্তরিক বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্য স্থাপন করাকে নিষিদ্ধ করে এ ধরণের আচরণে লিপ্ত ব্যক্তিদের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। সাথে সাথে এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার উৎস ও মূল কারণ বর্ণনা করে একেও অযথা অবান্তর প্রতিপন্ন করা হয়েছে এবং বলা হয়েছেঃ “তারা কি ওদের কাছে গিয়ে ইজ্জত-সম্মান লাভ করতে চায়? তবে ইজ্জত-সম্মানতো সম্পূর্ণভাবে মহান আল্লাহ তাআলারই মালিকানাধীন।” কাফের ও মুশরিকদের সাথে সৌহার্দ্য ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখা এবং অন্তরঙ্গ মেলা-মেশার প্রধান কারণ এই যে, তাদের বাহ্যিক মানমর্যাদা, শক্তি-সামর্থ্য, ধনবলে প্রভাবিত হয়ে মুসলমান হীনমন্যতার শিকার হয় এবং মনে করে যে, তাদের সাহায্য-সহযোগিতায় আমাদেরও মানমর্যাদা বৃদ্ধি পাবে।
একারণেই মহান আল্লাহ তাআলা তাদের ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করে বলেন যে, তারা এমন লোকদের সাহায্যে মর্যাদাবান হওয়ার আকাংখা করছে, যাদের নিজেদেরই সত্যিকারের কোন মর্যাদা নেই। তাছাড়া যে শক্তি ও বিজয়ের মধ্যে সত্যিকারের ইজ্জত ও সম্মান নিহিত, তা তো একমাত্র মহান আল্লাহ তা’আলারই মালিকানাধীন। অন্য কারো মধ্যে যখন কোন ক্ষমতা বা সাফল্য পরিদৃষ্ট হয়, তা সবই মহান আল্লাহ তা’আলা প্রদত্ত। অতএব, মানমর্যাদা দানকারী মালিককে অসন্তুষ্ট করে উনার শত্রুদের থেকে ইজ্জত হাসিল করার অপচেষ্টা কত বড় বোকামী। অর্থাৎ, কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি করলেই ইজ্জত-সম্মান পাওয়া যাবে না। কারণ, এটা মহান আল্লাহ তা’আলার এখতিয়ারধীন এবং তিনি সম্মান কেবল উনার অনুসারীদেরকেই দান করে থাকেন। মহান আল্লাহ তা’আলা অন্য এক আয়াতে পাঁকে বলেছেনঃ (مَنۡ کَانَ یُرِیۡدُ الۡعِزَّۃَ فَلِلّٰہِ الۡعِزَّۃُ جَمِیۡعًا) অর্থাৎ, কেউ সম্মান চাইলে জেনে রেখো, সমস্ত সম্মান (কেবল) মহান আল্লাহ তা’আলারই জন্য। (সূরা ফাত্বিরঃ ৩৫/১০) তিনি আরো বলেনঃ (وَ لِلّٰہِ الۡعِزَّۃُ وَ لِرَسُوۡلِہٖ وَ لِلۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ لٰکِنَّ الۡمُنٰفِقِیۡنَ لَا یَعۡلَمُوۡنَ) অর্থাৎ, সমস্থ ইজ্জত/সম্মান/মর্যাদা তো (কেবল) মহান আল্লাহ তা’আলা, রসুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এবং মু’মিনদের জন্যই, কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না। (সূরা মুনাফিকুনঃ ৬৩/৮) অর্থাৎ, যারা মুনাফিক ও কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করে সম্মান পাওয়ার আশায়, তারা বুঝেনা যে এটা হল লাঞ্ছনা ও অপমানের পথ, ইজ্জত ও সম্মানের পথ নয়।
মূলত এরা অত্যন্ত নিকৃষ্ট সাব্যস্থ হয়ে আছে কালামুল্লাহ শরীফ আসার পরেও তারা তা গ্রহণ না করে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে, যার কারণে এদের প্রতি সামান্যতম মুহব্বত ও রাখা যাবেনা। মহান আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَتَّخِذُوا الَّذِیۡنَ اتَّخَذُوۡا دِیۡنَکُمۡ هُزُوًا وَّ لَعِبًا مِّنَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ وَ الۡکُفَّارَ اَوۡلِیَآءَ ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ) হে ঈমানদারগণ! তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে যারা তোমাদের দ্বীনকে হাসি-তামাসা ও খেল-তামাশার বস্তু হিসেবে গ্রহণ করে তাদেরকে এবং কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না এবং মহান আল্লাহ তাআলাকে ভয় কর যদি তোমরা মু’মিন হও। (আল মায়েদা ৫/৫৭) আহলে কিতাব বা ‘পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে’ বলতে ইয়াহুদ, খ্রিষ্টান এবং অবিশ্বাসী বা কাফের বলতে মুশরিক উদ্দিষ্ট। এখানেও তাদের সাথে বন্ধুত্ব না করার জন্য তাকীদ করা হয়েছে। যারা ইসলাম ধর্মকে হাসি-তামাসা ও ক্রীড়ার বস্তুরূপে গ্রহণ করেছে। যেহেতু তারা মহান আল্লাহ তাআলা ও উনার রসূল ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের শত্রু, সেহেতু তাদের সাথে মু’মিনদের বন্ধুত্ব হতে পারে না কারণ আয়াতে বলা হচ্ছে যে, তোমাদের কাছে যে ঈমান মওজুদ আছে তার দাবী হচ্ছে, তোমরা তাদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানাবে না। তাদের কাছে দ্বীন প্রতিষ্টার গোপন কোন ভেদ প্রকাশ করবে না। তাদের সাথে বৈরীভাব রাখবে। তোমাদের কাছে যে তাক্বওয়া আছে তাও তোমাদেরকে তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে নিষেধ করে। আর যাদের তাক্বওয়া নাই, তারা অনায়াসে যার তাঁর সাথে বন্দুত্ব করতে পারে, মূলত এরা পথভ্রষ্ট গুমরাহ, কারণ মহান আল্লাহ তা’আলা বলছেনঃ (وَ لَوۡ کَانُوۡا یُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ النَّبِیِّ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡهِ مَا اتَّخَذُوۡهُمۡ اَوۡلِیَآءَ وَ لٰکِنَّ کَثِیۡرًا مِّنۡهُمۡ فٰسِقُوۡنَ) তারা যদি মহান আল্লাহ তা’আলা ও নবী করীম ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের এবং উনার প্রতি যা নাযিল (করা) হয়েছে তার উপর ঈমান আনতো, তবে তাদেরকে (অর্থাৎ কাফিরদেরকে) বন্ধুরূপে গ্রহণ করত না, কিন্তু তাদের অধিকাংশই (মূলত) ফাসিক। (আল মায়েদা ৫/৮১) তাদের এ কার্যের কারণে অর্থাৎ মুসলমানদের বন্ধুত্ব ছেড়ে দিয়ে কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব করার কারণে তারা তাদের জন্যে গুনাহের বড় যখীরা জমা করে রেখেছে। এরই প্রতিশোধ হিসেবে তাদের অন্তরে নেফাক বা কপটতা সৃষ্টি হয়েছে এবং প্রকৃত ব্যাপার এই যে, তাদের অধিকাংশ লোকই ফাসেক। অর্থাৎ তারা মহান আল্লাহ তা’আলা, ও রসূলে পাঁক ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য হতে সরে পড়েছে এবং উনার অহী ও পাক কালামের আয়াতগুলোর বিরোধী হয়ে গেছে। আর একারণেই তারা বুঝতেই পারেনা অমুসলিমদের বিরুদ্ধে দেওয়া মালিক মহান আল্লাহ পাঁকের সার্টিফিকেট তাদের চিরস্তায়ী দুষমনির ব্যপারে। যেমন, মহান আল্লাহ পাঁক বলেনঃ (لَتَجِدَنَّ اَشَدَّ النَّاسِ عَدَاوَۃً لِّلَّذِیۡنَ اٰمَنُوا الۡیَہُوۡدَ وَ الَّذِیۡنَ اَشۡرَکُوۡا) মানুষদের মধ্যে যারা (দ্বীন ইসলামের প্রতি) ঈমান এনেছে তাদের সাথে শক্রতার ব্যাপারে প্রথমেই তোমরা বেশী কঠোর (দেখতে) পাবে ইহুদীদের অতঃপর মুশরিকদের। (আল মায়েদা ৫/৮২) এর পরে মূলত আর কিছুই বলার থাকেনা, যেখানে মহান আল্লাহ পাঁক স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন যে কারা মুসলমানের শত্রু, কাদের সাথে বন্ধুত্ব করা যাবেনা, কাদের সাথে বন্ধুত্ব করলে মুসলমান তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে, কাদের মুহব্বত মানুষকে মহান আল্লাহ তা’আলার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। তবে মানুষ যেহেতু একা বাঁচতে পারেনা, জামাতহীন একা একা কোন মুসলমানের জন্যে দ্বীন পালন ও যায়েজ না, তখন স্বাভাবিকভাবেই চলা ফেরায়, উঠা বসায় কিছু মানুষের সাথে চলতে হবে, এই চলার পথে মানুষ মানুষের সাথে ঘনিষ্ট হয়, মুহব্বত চলে আসে, মানুষের সাথে মানুষের বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়, কিন্তু দ্বীন ইসলাম অনুসারে যারা বন্ধুত্ব গড়ে তোলে, কেবল তারাই কামিয়াব হয়।
যখন ইহুদী, মুশরিক ও নাসারদের সাথে বন্ধুত্ব নিষেধ করা হয়েছে, তখন কাদের সাথে বন্ধুত্ব করা যাবে? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা হচ্ছে, ঈমানদারগণের বন্ধু সর্বপ্রথম মহান আল্লাহ তাআলা ও উনার রসূল ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম, অতঃপর যারা মহান আল্লাহ তা’আলা, রসুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের একান্ত অনুগত। আর তাদের গুণাবলী উল্লেখ করে মহান আল্লাহ পাঁক বলেনঃ (اِنَّمَا وَلِیُّکُمُ اللّٰهُ وَ رَسُوۡلُهٗ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا الَّذِیۡنَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ یُؤۡتُوۡنَ الزَّکٰوۃَ وَ هُمۡ رٰکِعُوۡنَ وَ مَنۡ یَّتَوَلَّ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا فَاِنَّ حِزۡبَ اللّٰهِ هُمُ الۡغٰلِبُوۡنَ) তোমাদের বন্ধু কেবল মহান আল্লাহ তা’আলা, রসুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম ও মু’মিনগণ যারা নামায কায়িম করে, যাকাত প্রদান করে বিনীত হয়ে। (আর) যে কেউ মহান আল্লাহ তা’আলা ও রসুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এবং ঈমানদারগণকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে (সে দেখতে পাবে যে) মহান আল্লাহ তা’আলার দলই বিজয়ী হবে। (৫/৫৫-৫৬) অতঃপর মহান আল্লাহ পাঁক নারী পুরুষ উভয়কে লক্ষ্য করে বলতেছেনঃ (وَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتُ بَعۡضُهُمۡ اَوۡلِیَآءُ بَعۡضٍ ۘ یَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ یَنۡهَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ وَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ یُؤۡتُوۡنَ الزَّکٰوۃَ وَ یُطِیۡعُوۡنَ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ ؕ اُولٰٓئِکَ سَیَرۡحَمُهُمُ اللّٰهُ ؕ اِنَّ اللّٰهَ عَزِیۡزٌ حَکِیۡمٌ) আর মু’মিন পুরুষরা ও মু’মিনা নারীরা হচ্ছে একে অপরের বন্ধু, তারা (একে অন্যকে) ভাল কাজের আদেশ দেয় এবং অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে, আর তারা নামায কায়িম করে, যাকাত প্রদান করে এবং মহান আল্লাহ তা’আলা ও উনার রসূল ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য করে। এদেরকে মহান আল্লাহ তা’আলা শীঘ্রই দয়া করবেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তা’আলা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (আত্ব তাওবা ৯/৭১) অর্থাৎ মুসলমানদের গভীর বন্ধুত্ব ও বিশেষ বন্ধুত্ব যাদের সাথে হতে পারে, তাদের গুণাগুণ বর্ণনা করা হচ্ছে। মুমিন মুমিনাদের ব্যপারে বলা হয়েছে, প্রথমতঃ তারা পূর্ণ আদব ও শর্তাদিসহ নিয়মিত নামায আদায় করে। দ্বিতীয়তঃ স্বীয় অর্থ-সম্পদ থেকে যাকাত প্রদান করে। তৃতীয়তঃ তারা বিনম্র ও বিনয়ী হবে, স্বীয় সৎকর্মের জন্য কখনোই গর্বিত হবে না, তারা মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার করবে। পরের আয়াতে বলেছেন, “তারা (একে অন্যকে) ভাল কাজের আদেশ দেয় এবং অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে”। এই হচ্ছে হাক্বিকতে মুমিন মুমিনার বন্ধুত্বের নমুনা।
ফাইরোয আদ-দাইলামী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, উনার সম্প্রদায় ইসলাম গ্রহণ করার পর রসুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের কাছে তাদের প্রতিনিধি পাঠালেন। তারা এসে বললঃ ইয়া রসুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম, আমরা তো ঈমান এনেছি, এখন আমার বন্ধু-অভিভাবক কে? তিনি বললেন, মহান আল্লাহ ও উনার রসুল ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম। তারা বললেনঃ আমাদের জন্য এটাই যথেষ্ট এবং আমরা এতেই সন্তুষ্ট। (মুসনাদে আহমাদঃ ৪/২৩২) অতঃপর যাদের বন্ধু হয়ে যাবেন মহান আল্লাহ ও রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম। তাদের ব্যপারে মহান আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ ( اَلَاۤ اِنَّ اَوۡلِیَآءَ اللّٰهِ لَا خَوۡفٌ عَلَیۡهِمۡ وَ لَا هُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ) জেনে রেখ! নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তা’আলার অলীদের (বন্ধুদের) কোন ভয় নেই আর তারা পেরেশানও হবে না। (ইউনূস আলাইহিস সালাম ১০/৬২)
উপরোক্ত আয়াতে পাঁক সমূহে মহান আল্লাহ তা’আলা উনার বন্ধুদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, তাদের প্রশংসা ও পরিচয় বর্ণনার সাথে সাথে তাদের প্রতি আখেরাতের সুসংবাদ ও দিয়েছেন। তিনি বলেছেনঃ যারা মহান আল্লাহ তা’আলার “বন্ধু হবে” তাদের না থাকবে কোন অপছন্দনীয় বিষয়ের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা, আর না থাকবে কোন উদ্দেশ্যে ব্যর্থতার গ্লানি। এদের জন্য পার্থিব জীবনেও সু-সংবাদ রয়েছে এবং আছে আখেরাতেও। দুনিয়াতেও তারা দুঃখ-ভয় থেকে মুক্ত। আর আখেরাতে তাদের মনে কোন চিন্তা-পেরেশানি থাকবে না অর্থাৎ তারা জান্নাতে যাবে নিশ্চিত।
আয়াতে উল্লেখিত ‘আওলিয়া’ শব্দটি অলী শব্দের বহুবচন। আরবী ভাষায় অলী অর্থ খুব কাছের বা নিকটবর্তী হয় এমন এবং দোস্ত-বন্ধু বান্ধব ও হয়। শরীঅতের পরিভাষায় অলী বলতে বুঝায়ঃ যার মধ্যে দুটি গুণ আছেঃ ঈমান এবং তাকওয়া। যেহেতু মহান আল্লাহ তাআলার অলী বলতে মুমিন ও মুত্তাকীদের বুঝায় সেহেতু বান্দার ঈমান ও তাকওয়া অনুসারে মহান আল্লাহ তা’আলার কাছে তার বেলায়াত তথা বন্ধুত্ব নির্ধারিত হবে। সুতরাং যার ঈমান ও তাকওয়া সবচেয়ে বেশী পূর্ণ, তার বেলায়াত তথা মহান আল্লাহ তা’আলার বন্ধুত্ব সবচেয়ে বেশী লাভ হবে। ফলে মানুষের মধ্যে তাদের ঈমান ও তাকওয়ার ভিত্তিতে মহান আল্লাহ তা’আলার বেলায়াতের মধ্যেও তারতম্য হবে।
মহান আল্লাহ তা’আলার অলীদের সম্পর্কে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জেনে রাখাও প্রয়োজনঃ
১. মহান আল্লাহ তা’আলার নবী আলাইহিমুস সালামরা উনার সর্বশ্রেষ্ঠ অলী হিসাবে স্বীকৃত। নবী আলাইহিমুস সালামদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন উনার রাসূল আলাইহিমুস সালামগণ। রাসূল আলাইহিমুস সালামদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেনঃ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূল আলাইহিমুস সালামগণ তথা নূহ আলাইহিস সালাম, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম, মূসা আলাইহিস সালাম, ঈসা আলাইহিস সালাম এবং রসূলে পাঁক ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম। আর সমস্ত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রসূল আলাইহিমুস সালামদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেনঃ রসূলে পাঁক ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম।
২. এখানে এটা জানা আবশ্যক যে, মহান আল্লাহ তা’আলার অলীগণ দুশ্রেণীতে বিভক্তঃ প্রথম শ্রেণীঃ যারা অগ্রবর্তী ও নৈকট্যপ্রাপ্ত। দ্বিতীয় শ্রেণীঃ যারা ডান ও মধ্যম পন্থী।
মহান আল্লাহ তা'আলা পবিত্র আল কুরআনের বিভিন্ন স্থানে তাদের উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনঃ (إِذَا وَقَعَتِ الْوَاقِعَةُ لَيْسَ لِوَقْعَتِهَا كَاذِبَةٌ خَافِضَةٌ رَافِعَةٌ إِذَا رُجَّتِ الْأَرْضُ رَجًّا وَبُسَّتِ الْجِبَالُ بَسًّا فَكَانَتْ هَبَاءً مُنْبَثًّا وَكُنْتُمْ أَزْوَاجًا ثَلَاثَةً فَأَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ مَا أَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ وَأَصْحَابُ الْمَشْأَمَةِ مَا أَصْحَابُ الْمَشْأَمَةِ وَالسَّابِقُونَ السَّابِقُونَ أُولَٰئِكَ الْمُقَرَّبُونَ فِي جَنَّاتِ النَّعِيمِ) “যখন সেই অবশ্যম্ভাবী (কিয়ামতের) ঘটনাটি ঘটবে, তখন তার সংঘটিত হওয়ার বিষয়টাকে অস্বীকার করার মতো কেউ থাকবে না। এটা কাউকে করবে নীচু, কাউকে করবে সমুন্নত। যখন প্রবল কম্পনে প্রকম্পিত হবে যমীন। আর পর্বতমালা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়বে। ফলে তা উৎক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পর্যবসিত হবে। এবং তোমরা বিভক্ত হয়ে পড়বে তিন শ্রেনীতেঃ- তখন ডান দিকে (হবে একটি) দল; (আর) ডান দিকের দলটি কতইনা সৌভাগ্যবান! এবং বাম দিকের (ও একটি) দল (হবে); আর বাম দিকের দলটি কতইনা হতভাগা!। আর (দুনিয়ায় ঈমানে) অগ্রবর্তীরা তো (পরকালেও) অগ্রবর্তী। তারাই (মহান আল্লাহ তা’আলার) নৈকট্যপ্রাপ্ত, তারা থাকবে নিআমতপূর্ণ জান্নাতসমূহে। (ওয়াকি'আহঃ ৫৬/১–১২)
এখানে তিন শ্রেণীর লোকের উল্লেখ করা হয়েছেঃ যাদের একদল জাহান্নামের, তাদেরকে বামদিকের দল বলা হয়েছে। আর বাকী দু’দল জান্নাতের, তারা হলেনঃ ডানদিকের দল এবং অগ্রবর্তী ও নৈকট্যপ্রাপ্তগণ। তাদেরকে আবার এ সূরারই শেষে মহান আল্লাহ তা'আলা উল্লেখ করে বলেছেনঃ (فَاَمَّاۤ اِنۡ کَانَ مِنَ الۡمُقَرَّبِیۡنَ فَرَوۡحٌ وَّ رَیۡحَانٌ ۬ۙ وَّ جَنَّتُ نَعِیۡمٍ وَ اَمَّاۤ اِنۡ کَانَ مِنۡ اَصۡحٰبِ الۡیَمِیۡنِ فَسَلٰمٌ لَّکَ مِنۡ اَصۡحٰبِ الۡیَمِیۡنِ وَ اَمَّاۤ اِنۡ کَانَ مِنَ الۡمُکَذِّبِیۡنَ الضَّآلِّیۡنَ فَنُزُلٌ مِّنۡ حَمِیۡمٍ وَّ تَصۡلِیَۃُ جَحِیۡمٍ اِنَّ هٰذَا لَهُوَ حَقُّ الۡیَقِیۡنِ) “অতএব সে যদি (মহান আল্লাহ তা’আলার) নৈকট্য প্রাপ্তদের একজন হয় তবে তার জন্য রয়েছে আরাম(‘এর জীবন), উত্তম জীবনোপকরণ ও নেয়ামতে পূর্ণ জান্নাত। আর যদি সে ডান দিকের একজন হয় তবে (তাঁকে বলা হবে) তোমার জন্য সালাম ও শান্তি; যেহেতু তুমি ডান দিকের একজন। আর সে যদি সত্য অস্বীকারকারী গুমরাহদের অন্তর্গত হয়, তবে তার মেহমানদারী হবে প্রচন্ড উত্তপ্ত (ফুটন্ত) পানি দিয়ে। আর (তার জন্য আছে) জাহান্নামের আগুনের দহন। (আর) এটাতো ধ্রুব সত্য। (ওয়াকি'আহ ৫৬/৮৮–৯৫)
এখন কেউ যদি নৈকট্য প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হতে চায়, তাহলে তাঁর মান মর্যাদা ও হাক্বিকি দ্বীনি অবস্থান কেমন হবে তাঁর ব্যপারে “মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন, “যে ব্যক্তি আমার কোন ওলীর/বন্ধুর সঙ্গে দুশমনি করবে, আমি তার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করব। আমি আমার বান্দার উপর যা কিছু ফরয করেছি (যেমনঃ নামায, যাকাত, রোজা, হজ্জ, জ্বিহাদ), সে মূলত এইসব দ্বারাই আমার নৈকট্য লাভ করে থাকে, (তবে) আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদাতের মাধ্যমেই আমার অধিক নৈকট্য লাভ করে থাকে। আর যখন সে (ফরজের পাশাপাশি অত্যাধিক নফল ইবাদত দ্বারা) আমার নৈকট্য লাভ করে ফেলে, তখন আমি তাকে আমার এমন মুহব্বতের মানুষ বানিয়ে ফেলি যে, আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমিই তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমিই তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে চলাফেরা করে। (আর তখন) সে যদি আমার কাছে কিছু চায়, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে (দুশমনঃ মানুষ কিংবা শয়তান) থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তাহলে আমি অবশ্যই তাকে পানাহ দান করি। আর আমি যখন কোন কাজ করতে চাই, তখন আমি তা করতে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগি না, যতটা দ্বিধা করি মু’মিন বান্দার প্রাণ বের করে নিতে। কারণ সে মৃত্যু যন্ত্রনাকে অপছন্দ করে আর আমি তার কষ্ট পাওয়াকে অপছন্দ করি। (বুখারি শরীফ ৬৫০২)
এর মর্ম হলো এই যে, তার কোন গতি-স্থিতি ও অন্য যে কোন কাজ আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয় না। বস্তুতঃ এই বিশেষ ওলীত্ব বা নৈকট্যের স্তর অগণিত ও অশেষ। এর সর্বোচ্চ স্তর নবী-রাসূলগণের প্রাপ্য। কারণ, প্রত্যেক নবীরই ওলীয়ে ইলাহী হওয়া অপরিহার্য। আর এর সর্বোচ্চ স্তর হলো সাইয়্যিদুল মুরছালিন ইমামুল আম্বীয়া ওয়াল মুরছালিন, রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলাইহি ওয়াসাল্লামের। এর পর প্রত্যেক ঈমানদার তার ঈমানের শক্তি ও স্তরের বৃদ্ধি-ঘাটতি অনুসারে বেলায়েতের অধিকারী হবে। সুতরাং নেককার লোকেরা হলোঃ ডান দিকের দল, যারা মহান আল্লাহ তা’আলার কাছে ফরয আদায়ের মাধ্যমে নৈকট্য লাভ করে। তারা মহান আল্লাহ তা’আলা তাদের উপর যা ফরয করেছেন তা আদায় করে, আর যা হারাম করেছেন তা পরিত্যাগ করে। তারা নফল কাজে রত হয় না। কিন্তু যারা অগ্রবর্তী নৈকট্যপ্রাপ্ত দল তারা মহান আল্লাহ তা’আলার কাছে ফরয আদায়ের পর নফলের মাধ্যমে অধিক নৈকট্য লাভে রত হয়।
৩. এখানে আরও একটি বিষয় জানা আবশ্যক যে, মহান আল্লাহ তা’আলার অলীগণ অন্যান্য মানুষদের থেকে যে বিষয় দ্বারা আলাধা হয়ে থাকেন বা পরিচিত হন তা হলো, রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলাইহি ওয়াসাল্লামের শতভাগ সুন্নাহ অনুসরণে তারা জীবনযাপন করে থাকেন। কোন ধরণের যুলুম, হিংসা বিদ্বেষ, লোভের অস্তিত্ব তাদের মধ্যে পাওয়া যায়না। দুনিয়া বিমুখী হাক্বিকি ইল্মে তাসাউফ ও দ্বীন প্রতিষ্টার অন্যতম ফরজ কাজ জ্বিহাদের চেতনা চেষ্টায় রত থাকেন সদা সর্বদা। তাদের বর্ণনা রয়েছে কুরআনের পরতে পরতে।
৪. মহান আল্লাহ তা’আলার অলীগণের মধ্যে নবী-রাসূলগণ ছাড়া আর কেউ নিষ্পাপ নন, তবে তারা যখন মহান আল্লাহ তা’আলার অলি আউলিয়ার মাক্বামে পৌঁছে যান তখন তারা গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে যান যা (বুখারি শরীফ ৬৫০২) হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। আর মহান আল্লাহ তা’আলার হাক্বিকি অলীগণ নিজেদেরকে সম্মান করতে অথবা কোন ধন-সম্পদ তাদের উদ্দেশ্যে ব্যয় করতে মানুষদেরকে আহবান করেন না। যদি কেউ এমন কিছু করে তাহলে সে মহান আল্লাহ তা’আলার অলী হতে পারে না, বরং মিথ্যাবাদী, অপবাদ আরোপকারী, শয়তানের আলী হিসাবে বিবেচিত হবে।
৫. মহান আল্লাহ তা’আলার অলী হওয়ার জন্য একটি মাত্র উপায়ই রয়েছে, আর তা হচ্ছে, রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লামের রঙে রঞ্জিত হওয়া, উনার সুন্নাতের হুবহু অনুসরণ করা। যারা এ ধরনের অনুসরণ করতে পেরেছেন তাদের মর্যাদাই আলাদা।
যাইহোক মূল প্রসঙ্গে চলে আসি, আমাদের মুহব্বতের মাপকাঠি যেন সর্বক্ষেত্রে মহান আল্লাহ তা’আলা ও রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম হয়ে থাকেন। কারণ মুহব্বত যখন উনাদের রেজামন্দি সন্তুষ্টির কারণে হবে তখন এর বেশুরাম ফযিলত পাওয়া যাবে। যখন মানুষ তাঁর মাওলাজীর সন্তুষ্টির উদ্যেশ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে, মুহব্বত করে, ভালোবাসে, তখন এর বদলা বর্ণনাতীত। বন্ধুত্ব করা উচিত। তবে তা কোন পার্থিব স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে নয়। বন্ধুত্ব হতে হবে মহান আল্লাহ তা’আলার ওয়াস্তে। অর্থাৎ, একজনকে ভালোবাসবে শুধু এই জন্য যে, মহান আল্লাহ তা’আলা তাকে ভালোবাসেন, অথবা তাকে ভালোবাসলে মহান আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি লাভ সম্ভব হবে, অথবা তার সহিত বন্ধুত্ব রাখলে মহান আল্লাহ তা’আলা ও তার দ্বীন বিষয়ে বহু কিছু জানা যাবে, অথবা তার সংসর্গে আল্লাহর ইবাদত সঠিক ও সহজ হবে, অথবা তার পরিবেশে মিশে ইসলামী পরিবেশ গড়া সহজ হবে। এই উদ্দেশ্যই হল বন্ধুত্ব করার মহান উদ্দেশ্য। এমন সৎ উদ্দেশ্যের রয়েছে বিশাল মর্যাদা।
এখন হয়তো অনেকেই আছেন যারা বন্ধুত্বের বাজারে ঠগ খেয়ে বা কাউকে ঠকতে দেখে একা থাকাকেই বেঁছে নিয়েছেন এবং মোটেই কোন মানুষের সঙ্গে মিশতে চান না। ফলে মাথা ব্যথা করলে তা সারার চেষ্টা না করে, মাথাটাই কেটে ফেলার ফায়সালা করে নেন। অথচ রসুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে মু'মিন মানুষের মাঝে মিশে তাদের কষ্টদানে ধৈর্যধারণ করে সেই মু’মিন ঐ মু'মিন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, যে লোকেদের সাথে মিশে না এবং তাদের কষ্টদানে ধৈর্যধারণ করে না।” (আহমাদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, সহীহুল জামে ৬৬৫১) অতএব একা থাকার কোন সুযোগ নাই, বরং মিল মুহব্বত রেখে চলতে হবে। আর এর ফায়দাও কল্পনাতীত। রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ অবশ্যই মহান আল্লাহ তা’আলার বান্দাদের মধ্যে এমন কিছু লোক রয়েছেন যারা নবী ও নন এবং শহীদও নন, অথচ ক্বিয়ামাতের দিন মহান আল্লাহ তাআলার দরবারে তাদের মর্যাদার কারণে নাবীগণ ও শহীদগণ তাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত হবেন। সাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমগণ বললেন, ইয়া রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম! আমাদেরকে উনাদের ব্যপারে অবহিত করুন, উনারা কারা? তিনি বলেন, তারা ঐসব লোক যারা কেবল মহান আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্য একে অন্যকে ভালোবেসে, অথচ তাদের মধ্যে না ছিলো রক্তের সম্পর্ক না ছিলো মালের। মহান আল্লাহ তা’আলার কসম! তাদের চেহারা হবে নূরানী (উজ্জ্বল) এবং তারা নূরের আসনে বসে থাকবে। যখন মানুষ ভয় পাবে, তখন তাদের কোন ভয় হবে না এবং যখন মানুষ দুঃখে থাকবে, তখনও তাদের কোন দুঃখ ও চিন্তা-পেরেশানি থাকবে না। অতঃপর তিনি পাঠ করলেনঃ (أَلَآ إِنَّ أَوْلِيَآءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ) অর্থাৎ “সাবধান! নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তা’আলার বন্ধুগণের কোন ভয় নেই। এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হবে না”। (আল কুরআন ১০/৬২, ইবনে হিব্বানঃ ৫৭৩, আবু দাউদঃ ৩৫২৭, সহীহ আত্ তারগীব ৩০২৬, আহমাদ ২২৮৯৭, মুসনাদে আবূ ইয়া‘লা ৬৮৪২, হিলইয়াতুল আওলিয়া ১/৫, সুনানুন্ নাসায়ী আল কুবরা ১১২৩৬, শু‘আবুল ঈমান ৮৯৯৭)
চিন্তা করা যায়? এমন মর্যাদার অধিকারী আল্লাহ তা’আলা বানিয়ে দেবেন কেবল মুহব্বতের মধ্যে মানুষের আপন নফসের যায়গায় উনার উপস্থিতি থাকলে। অন্য বর্ণনায় পাওয়া যায় রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “বিভিন্ন দিক থেকে মানুষ আসবে এবং বিভিন্ন গোত্র থেকে মানুষ এসে জড়ো হবে, যাদের মাঝে কোন আতীয়তার সম্পর্ক থাকবে না। তারা কেবল মহান আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একে অপরকে ভালবেসেছে, মহান আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যুদ্ধে স্থাপন করবেন, তারপর তাদেরকে সেগুলোতে বসাবেন। তাদের বৈশিষ্ট হলো মানুষ যখন ভীত হয় তখন তারা ভীত হয় না, মানুষ যখন পেরেশান হয় তখন তারা পেরেশান হয় না। তারা আল্লাহ তা’আলার বন্ধুগন, তাদের কোন ভয় ও পেরেশানী কিছুই থাকবে না। (মুসনাদে আহমাদ ৫/৩৪৩)।
আর তাই মহান আল্লাহ তা’আলার ওয়াস্তে বন্ধুত্ব কায়েম করার মাঝেই ঈমানের পরিপূর্ণতা, মিষ্টতা ও প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায়। রসূলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ তা’আলার ওয়াস্তে কাউকে ভালোবাসে, (এবং) মহান আল্লাহ তা’আলার ওয়াস্তেই কাউকে ঘৃণা করে, মহান আল্লাহ তা’আলার ওয়াস্তে কিছু দান করে এবং মহান আল্লাহ তা’আলার ওয়াস্তেই কিছু দান করা হতে বিরত থাকে, সে ব্যক্তি পূর্ণাঙ্গ ঈমানের অধিকারী।” (আবু দাউদ ৪৬৮১) এছাড়াও হাদিস শরীফে এসেছে যে, “তিনটি গুণ যার মধ্যে আছে, সে ঈমানের মিষ্টতা লাভ করেছে, ১) সকল বিষয়, বস্তু ও ব্যক্তির চাইতে মহান আল্লাহ তা’আলা ও উনার রসুল ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লামকে অধিক মুহব্বত করা। ২) কেবল মহান আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই কাউকে মুহব্বত করা এবং ৩) মহান আল্লাহ তা’আলা কুফরী থেকে রক্ষা করার পর পুনরায় তাতে ফিরে যাওয়াকে এমন অপছন্দ করা, যেমন আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপছন্দ করা হয়।” (বুখারী শরীফ ১৬, মুসলিম শরীফ ৪৩)।
রসূলে পাঁক ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেনঃ “যে ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ পেতে পছন্দ করে, সে ব্যক্তি যেন কেবল মহান আল্লাহ তা’আলার উদ্দেশ্যেই অপরকে মুহব্বত করে।” (মুসনাদে আহমাদ, বাযযার, সহীহুল জামে ৫৯৫৮) কারণ কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তা’আলা সাত ব্যক্তিকে উনার আরশের ছায়ায় স্থান দান করবেন, যেদিন উনার ঐ ছায়া ছাড়া আর অন্য কোন ছায়া থাকবে না; তন্মধ্যে সেই দুই ব্যক্তি অন্যতম, যারা মহান আল্লাহ তাআলার ওয়াস্তে বন্ধুত্ব স্থাপন করে এবং এই বন্ধুত্বের উপরেই তারা মিলিত হয় ও তারই উপর চিরবিচ্ছিন্ন (মৃত্যু) হয়।” (বুখারী শরীফ ৬৬০, মুসলিম শরীফ ১০৩১) শুধু আরশের ছায়ায় স্থান ই নয় বরং হাদিস শরীফ বলা হচ্ছে “ঈমানের সবচাইতে মজবুত হাতল হল, মহান আল্লাহ তা’আলার ওয়াস্তে বন্ধুত্ব স্থাপন করা, মহান আল্লাহ তা’আলার ওয়াস্তে শত্রুতা সৃষ্টি করা, মহান আল্লাহ তা’আলার ওয়াস্তে মুহব্বত করা এবং মহান আল্লাহ তা’আলারই ওয়াস্তে ঘৃণা পোষণ করা।” (ত্বাবারানী, সিলসিলাহ সহীহাহ ১৭২৮) এছাড়াও এরূপ মুহব্বতের অন্যতম ফায়দা হচ্ছে, এর দ্বারা খুব সহজেই মহান আল্লাহ তা’আলার মুহব্বত লাভ করা যায়। “মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, “আমার উদ্দেশ্যে আপোসে বন্ধুত্ব স্থাপনকারীদের জন্য আমার ভালোবাসা সুনিশ্চিত। আমার উদ্দেশ্যে আপোসে উপবেশনকারীদের জন্য আমার ভালোবাসা সুনিশ্চিত। আমার উদ্দেশ্যে আপোসে যিয়ারতকারীদের জন্য আমার ভালোবাসা সুনিশ্চিত এবং আমার উদ্দেশ্যে আপোসে খরচকারীদের জন্যও আমার ভালোবাসা সুনিশ্চিত।” (আহমাদ ৫/২৩৩ হা ১৭৭৯, ত্বাবারানী শরীফ, মুস্তাদারক হাকেম, সহীহুল জামে ৪৩৩/১)। এই বিষয়ে হাদিস শরীফে একটি ঘটনা পাওয়া যায়। ঘটনাটা এরূপঃ আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, “এক ব্যক্তি অন্য এক গ্রামে তার এক (দ্বীনী) ভায়ের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বের হল। মহান আল্লাহ তা’আলা তার গমন-পথে একজন অপেক্ষমাণ ফেরেশতা বসিয়ে দিলেন। (লোকটি সেখানে পৌছালে) ফিরিশতা আলাইহিস সালাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কোথায় যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়েছ? সে বলল, “অমুক গ্রামে আমার এক ভাই আছেন, তার সাক্ষাতে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়েছি।' ফেরেশতা আলাইহিস সালাম জিজ্ঞাসা করলেন, তার কাছে তোমার কোন সম্পদ আছে নাকি, যার দেখাশোনা করার জন্য তুমি যাচ্ছ? সে বলল, ‘না, আমি তাকে একমাত্র মহান আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ভালোবাসি, তাই যাচ্ছি। ফিরিশতা আলাইহিস সালাম বললেন, ‘আমি মহান আল্লাহ তা’আলার নিকট থেকে তোমার কাছে এই সংবাদ পৌছে দেওয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছি যে, মহান আল্লাহ তা’আলা তোমাকেও অনুরূপ ভালোবাসেন, যেরূপ তুমি উনার সন্তুষ্টি লাভের জন্য তোমার দ্বীনি ভাইকে ভালোবাস।” (মুসলিম শরীফ ২৫৬৭) ফিকিরের বিষয় একজন মানুষের জন্য এর চেয়ে ফখরের আর কি হতে পারে যে তাঁকে খোদ মালিক মহান আল্লাহ পাঁক ভালোবাসেন? তাছাড়া আল্লাহ তাআলার জন্য মুহব্বতকারি দুই বন্ধুর মধ্যেও আবার মর্যাদার তফাৎ আছে। হাদিস শরীফে এসেছেঃ “যখন দুই ব্যক্তি মহান আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি কামনা করে আপোসে বন্ধুত্ব স্থাপন করে, তখন তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয় সেই ব্যক্তি, যে অপরকে গভীরভাবে মুহব্বত করে।” (সহীহুল জামে ৫৫৯৪)
তাই বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে খুবই কেয়ারফুল থাকতে হবে। ইমাম গাজ্জালি রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হলে তিনটি গুণের দিকে লক্ষ রাখবেঃ ১. সে নেককার ও পুণ্যবান কি না? ২. চরিত্রবান কি না? ৩. জ্ঞানী ও বিচক্ষণ কি না।
এছাড়াও ইমাম হজরত জয়নুল আবেদিন আলাইহিস সালাম উনার ছেলে ইমাম মুহাম্মদ আল-বাকির আলাইহিস সালামকে উপদেশ দিতে গিয়ে পাঁচ ধরনের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেনঃ ১. মিথ্যাবাদী, ২. পাপী, ৩. কৃপণ, ৪. বোকা ও ৫. যারা স্বজনদের সঙ্গে প্রতারণা করে।
একবার রসুলুল্লাহ ছ্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করা হলোঃ আমাদের সঙ্গীদের মধ্যে সেরা কে? তিনি বল্লেন, তোমাদের সর্বোৎকৃষ্ট সাথী সেঃ
১) যার সাথে সাক্ষাৎ হলে, তার সূরত তোমাদেরকে মহান আল্লাহ তা’আলার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
২) যার কথায় (শ্রবনে) ইলম (দ্বীনি জ্ঞান) বৃদ্ধি পায়।
৩) যার কাজ-কর্ম তোমাদের আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। (হদিস শরীফটি ইমাম বুসিরি রহিমাহুল্লাহ উনার ইতহাফুল খিয়ারাহ: ৮/১৬৩, আবদ ইবনে হুমায়দ রহিমাহুল্লাহ উনার আল-মুনতাখাব, হাদিস নং ৬৩০, আবু ইয়ালা হাদিস নং ২৪৩৭, এবং বাজ্জার রাহিমাহুল্লাহ সাইয়্যিদুনা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণনা করেন)
অতএব প্রিয় ভাই ও বোনেরা! ভেবে দেখ, তোমাদের জীবনের বিশাল অংশ জুড়ে যারা বন্ধুর স্থান দখল করে রয়েছে, তা কোন স্বার্থলাভ, বা অর্থ লাভের জন্য নয় তো? তুমরা যাকে ভালোবাস, সে ভালোবাসা তার মাল, সামাজিক অবস্থান, বা রূপ ও সৌন্দর্যের জন্য তো নয়? তার খেলা, অভিনয় বা গান ভালো লাগে তাই তাকে ভালোবাস এমন নয় তো? তোমার এই বন্ধুত্ব কোন রাজনৈতিক দল বা মতের ভিত্তিতে নয় তো? তেমন কিছু হলে সে মুহব্বত সে বন্ধুত্ব, সে ভালোবাসা ও প্রেম-প্রীতির কোন মূল্যই নেই।
মহান আল্লাহ তা'আলার ওয়াস্তে ও দ্বীনের স্বার্থে যে মুহব্বত হয়, সে মুহব্বত অনির্বাণ, চিরকালীন। এমন মুহব্বতেরই দুই বন্ধু ছায়াহীন কিয়ামতের দিনে মহান আল্লাহ তা’আলার বিশেষ ছায়া লাভ করবে। এমন মুহব্বত ও দোস্তী সেই ভীষণ কিয়ামতের দিনেও অক্ষত থাকবেঃ (وَ لَا یَسۡـَٔلُ حَمِیۡمٌ حَمِیۡمًا) “যেদিন কোন বন্ধু কোন বন্ধুকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেনা।” (মাআরিজ ৭০/১০) এমনকি (اَلۡاَخِلَّآءُ یَوۡمَئِذٍۭ بَعۡضُہُمۡ لِبَعۡضٍ عَدُوٌّ اِلَّا الۡمُتَّقِیۡنَ) সেদিন বন্ধুরা এক অপরের শত্রু হয়ে যাবে মুত্তাকীরা ছাড়া।” (যুখরুফ ৪৩/৬৭) দুনিয়া আখিরাতে কোন মুত্তাকীর বন্ধুত্বের বন্ধন চ্ছিন্ন হবে না। তাই কে তোমার বন্ধু? কাকে তুমি বন্ধুরূপে গ্রহণ করে নিজের হৃদয়ের কোণে আসন দিয়েছ? কার নিকট তুমি তোমার জীবনের সকল রহস্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছ? তা ভেবে দেখেছ কি?
বন্ধু বন্ধুর কথা মত চলে, তার চরিত্র মত গড়ে ওঠে। দু’টি মনের অপূর্ব মিল হলে তবেই বন্ধুত্বের খাতির সহজে জমে ওঠে। এমন না হলে উভয়ের মধ্যে একজন প্রভাবশালী হয় এবং অপর জন হয় প্রভাবান্বিত। অতএব এ ক্ষেত্রে এমন সাথী নির্বাচন করা উচিত, যাতে বন্ধুত্বের আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থ না হয়। এ কথা বাস্তব যে, শুধু মানুষের মাঝেই নয়, পশু-পক্ষীর মাঝেও এমন ‘জাতীয়তাবাদ’ লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ, যে যে জাতের পাখী, সে সেই জাতের পাখীর দলেই গিয়ে মিশে থাকে, অন্যথা নয়। মালেক বিন দীনার বলেন, একদিন একটি কাককে একটি পায়রার সঙ্গে বসে থাকতে দেখে আমি অবাক হলাম। ভাবলাম, এমন তো হওয়ার কথা নয়, কিন্তু হল কেন? পরক্ষণে দেখা গেল যে, উভয় পাখীই ছিল খোড়া। তাই খোড়ায়-খোড়ায় এক ধরনের মিল থাকার পরিপ্রেক্ষিতেই ঐ দুই জাতের পাখী ভাবের সাথে একত্রে বসেছিল।
মানুষের মাঝেও তাই। সাধারণতঃ যে মানুষ যে গুণ, চরিত্র ও আকৃতির, সে মানুষ ঠিক তারই মত একজন মানুষকে বেছে নিয়ে তার সহিত উঠা-বসা ও বন্ধুত্ব করে। হে আমার প্রিয় দ্বিনি ভাই ও বোনেরাঃ উত্তম চরিত্রের দ্বীনদার যুবক যুবতীদের প্রতি তোমার মন যদি বীতশ্রদ্ধ হয়, তাহলে জেনে রেখো যে, তোমার মাঝে কোন রোগ আছে; হয় ঈমানী রক্তস্বল্পতা, নচেৎ সন্দেহের যক্ষা, নতুবা প্রবৃত্তিপূজার রক্তচাপ। সুতরাং বন্ধুত্ব করার পূর্বে এসব রোগ সারিয়ে নিও। যদি তুমি মনে মনে গর্বিত হও এই ভেবে যে, তুমিই একমাত্র চরিত্রবান যুবক/যুবতি, তোমার মত সভ্য মানুষ আর কেউ নেই; অতএব তোমার মানের যোগ্য বন্ধু আর কেউ হতে পারে না। তাহলে এ ধারণাকে তুমি মিথ্যা জেনো। তোমার মনের মণিকোঠায় সন্ধান করে দেখো, সেখানে অহংকারী শয়তানের বাসা রয়েছে। সুতরাং সে সময় তুমি আউযুবিল্লাহ পাঠ করো।
আর যদি তুমি দেখো যে, তোমার নিজের মাঝে ত্রুটি আছে, কিন্তু ভালো লোককে ভালোবাস, তাদের প্রতি মন আকৃষ্ট হয়, তাদের সহিত উঠতে-বসতে ভালো লাগে, তাহলে ভেবো যে, তোমার মধ্যে কিছু মঙ্গল রয়েছে। সুতরাং সে সময় ঐ মঙ্গলকে যথাযথভাবে প্রতিপালিত কর এবং চেষ্টা কর, যাতে তাদের দলে শামিল হতে পার। তাদের সাথে বন্ধুত্ব কায়েম করার সর্বাত্মক চেষ্টা করো।
0 ফেইসবুক: